প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই ২০২৩

Share This News

ব্রিটেনে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সার্জনই ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত

ব্রিটেনে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সার্জনই ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বৃটেনে ব্রেস্ট ক্যান্সার সার্জন ড. লিজ ও’রিওর্ডান। তিনি নারীদের ব্রেস্ট বা স্তনে প্রাণঘাতী ক্যান্সারের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। কিন্তু তার বুকে যে ধীরে ধীরে এই ক্যান্সার বাসা বাঁধছে, তা প্রথমদিকে টের পাননি। পরীক্ষায় ধরা পড়ে তিনি ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত। তারপর নিজেকে অপারেশন থিয়েটারে যেতে হয়। কেটে ফেলা হয় ব্রেস্ট। তার ধারাবাহিকতায় গর্ভাশয়। যিনি নিজে এসব চিকিৎসা দিয়েছেন, তিনি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পেশা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তিনি একজন ব্রেস্ট ক্যান্সারের সার্জন, লেখিকা, পডকাস্টার। তার স্মৃতিকথা ‘আন্ডার দ্য নাইফ: লাইফ লেসনস ফ্রম দ্য অপারেশন থিয়েটার’ প্রকাশ করেছে আনবাউন্ড।

যে হাসপাতালে আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম, সেখানেই চিকিৎসা নেয়া শুরু করলাম। আমার সাবেক সহকর্মীরা আমার অপারেশন করলো। তাদের সবাই-ই অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে অপারেশন করলো। কিন্তু থিয়েটারে যাওয়ার সময় যে আবেগ তা অনুভব করেছি। সব রোগীকে এই অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশের আগে দেখেছি হাউমাউ করে কাঁদতে। এবারই প্রথম তাদের অনুভূতি বুঝতে পারলাম। আমার সার্জনকে শুধু বলতে চাইলাম- আপনি কি সেলাই করবেন? এখানে কি কুরক্ত ঝরে যাওয়ার জন্য ড্রেইন তৈরি করবেন? এসব ড্রেসিং ব্যবহার করবেন? জবাবে ওই সার্জন আমাকে চুপ করতে বললেন। তিনি আরও বললেন- ধৈর্য্য ধর। তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি আমি। কিন্তু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ তার হাতে দেয়া আমার জন্য খুব কষ্টের ছিল।

তার জীবনের সেই দিনগুলো তিনি শেয়ার করেছেন লন্ডনের অনলাইন গার্ডিয়ানকে। চলুন তার মুখেই শুনে আসি ঘটনা-

আমার বয়স তখন ১৮ বছর। একটি হাসপাতালে কাজের অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য উপস্থিত হলাম। দেখলাম আমার এক বন্ধুর পিতার অপারেশন। থিয়েটারের মধ্যে প্রবেশের মুহূর্তেই দেখতে পেলাম অন্ত্রটি তুলে আনা হচ্ছে। আমার মনে হলো বিষয়টি তো বিস্ময়কর। আমাকেও এটা শিখতে হবে।

একজন ব্রেস্ট সার্জন হিসেবে অপারেশনে শৈল্পিকতাকে ভালবাসি। ভালবাসি রোগীর সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। কিন্তু কখনোই আমি আমার নিজের ব্রেস্ট পরীক্ষা করিনি। ভাবতাম আমি তো একজন ব্রেস্ট সার্জন। আমার ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে যাবে কেন! আসলে এমন ভাবনা ছিল পুরোপুরি উদ্ভট ব্যাপার। এক পর্যায়ে আমার ব্রেস্টে কিছু একটা স্ফীত অংশ লক্ষ্য করলাম। আলট্রাসাউন্ড করালাম। কমপিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে ছিলাম। তাৎক্ষণিকভাবে যা দেখলাম তাতে আমি নিশ্চিত ছিলাম- এটা ব্রেস্ট ক্যান্সার। আমার কেমোথেরাপি প্রয়োজন। অপারেশন করে ব্রেস্ট ফেলে দিতে হবে। এই রোগ হলে কি হয় সে সম্পর্কে আমার খুব ভাল ধারণা ছিল। আমি জানি এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে ১০ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত।

নিজের ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার আগে কখনো বুঝতে পারিনি এটা কতটা কষ্টদায়ক। আমি শুধু কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মৌলিক বিষয়গুলো জানি। এসবই ছিল ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের কাজ। কিন্তু আকস্মিকভাবে মাথা ঘোরাতে থাকে, কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। ঋতুস্রাবের লক্ষণগুলো আক্রান্ত হয়। এসবই রিলেশনশিপের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া যে জিনিস হারিয়েছেন তার জন্য বেদনাবোধ হয়। আমি এবং আমার স্বামীর তখনো কোনো সন্তান হয়নি। আমরা জানতাম কোমোথেরাপি নিলে তাতে আমি বন্ধ্যাও হয়ে যেতে পারি।

সুস্থ হয়ে উঠতে এবং কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য আমার হাতে দেড় বছর বা ১৮ মাস সময় ছিল। বিষয়টি আসলেই খুব কঠিন। প্রথমে আমি এমন কাউকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে দেখেছি, যে ছিল যুবতী। আমি দেখেছি এ খবর পাওয়ার পর সে ও তার স্বামী বেদনায় মুষড়ে পড়েছেন। এখন আমি ও আমার স্বামী একইভাবে ভাবি।

প্রথম যে অপারেশন আমি করেছি তার মধ্য দিয়ে স্বস্তি পেরেছি। আবার গর্বও অনুভব করেছি। কিন্তু যার অপারেশন করালাম তার কষ্টের কথা ভেবে মনটা ভারি হয়ে যেত। এমন সময় নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করা, এটা নৈতিক দিক থেকে ঠিক নয়। আমি আমার ভাষা বদলে ফেলেছি। এখন বলি- আমরা সৌভাগ্যবান এ জন্য যে, প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারটা ধরা পড়েছিল। আমার সৌভাগ্য যে, এটা ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু কারও ক্যান্সার হওয়া ভাল নয়।

আমি বিব্রত এ জন্য যে, নিজের ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ার আগে কোনো ব্রেস্ট ক্যান্সার বিষয়ক ফোরামে যাইনি। যদি কোনো চিকিৎসক এমন ফোরামে যান তাহলে তা তার জন্য সহায়ক হবে। রোগী সম্পর্কে ধারনা নিতে পারবেন। আমি আসলে এ সময়টাতে নেটওয়ার্কিংয়ে খুব ব্যস্ত। ফলে কোনো কনফারেন্সে রোগীদের কথা শুনিনি। রোগীদের অভিজ্ঞতার কথা সবারই শোনা উচিত।

পাঁচ মাস পরে আমি কাজে ফিরলাম। আমার ক্যারিয়ার আবার শুরু হলো। এর মধ্যে আমার স্ফীত অংশ ফেলে দেয়া হয়েছে। আরও রেডিওথেরাপি নিতে হয়েছে। আমার গর্ভাশয় ফেলে দেয়া হয়েছে। এ জন্য আমাকে অবসরে যেতে বাধ্য করা হলো। কারণ, বাম হাতের বাহু আর নাড়াতে পারছিলাম না। নিরাপদে এ কারণে অপারেশনও করতে পারছিলাম না। আমার জীবন থেকে ২০টি বছর চলে গেল। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়লাম। এখন কথা বলে, ব্লগিং করে এবং ভিডিও করে সময় কাটাই। মানুষকে সাহায্য করার জন্য আমার নিজস্ব একটি পন্থা আছে। কিন্তু যে পেশা আমার নয়, তার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়া খুব কঠিন।

সর্বশেষ যে অপারেশন করেছি তা স্মরণ করতে পারছি না। ওই অপারেশনের পরের দিনই আমার বায়োপ্সি রিপোর্ট হাতে পাই। কিন্তু আমি কখনো পশ্চাতে ধাবিত হই নি। যদি জানতাম ওটাই ছিল আমার শেষ অপারেশন তাহলে ভিন্নভাবে তা করতে পারতাম।