প্রকাশিত : বুধবার, ২ আগস্ট ২০২৩

Share This News

খেলাপি ঋণে ডুবছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৫ ব্যাংক

খেলাপি ঋণে ডুবছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৫ ব্যাংক

দেশের ব্যাংক খাতের উন্নতিতে বড় বাধা হয়ে উঠেছে খেলাপি ঋণ। দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ২০১৩ সালে অনুমতি পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের ৯টি ব্যাংকও রক্ষা পায়নি এই খেলাপি ঋণের কবল থেকে। এরমধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত পাঁচটি ব্যাংকও রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত মার্চ শেষে এই ৯টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। পাঁচ বছর আগে তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৯৪০ কোটি। অর্থাৎ পাঁচ বছরে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা।

৯টি ব্যাংকের মধ্যে দেশীয় উদ্যোক্তাদের পরিচালনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো মিডল্যান্ড, ইউনিয়ন, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স, গ্লোবাল ইসলামী এবং এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় এসে ২০১২ থেকে ১৩ সালের মধ্যে ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়। এরমধ্যে পাঁচটি ব্যাংক শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এই ব্যাংকগুলোকে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্যবসা শুরুর ৯ বছর পার হলেও ব্যাংকসেবায় বিশেষ কোনো নতুনত্ব আনতে পারেনি চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো। গতানুগতিক ধারায় কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি আর বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো। নানা অব্যবস্থাপনায় নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নিজেদের ইচ্ছামতো চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠান। ঋণের নামে চলছে লুটপাট। দিন দিন বাড়ছে খেলাপি ঋণের বোঝা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা ব্যাংকপাড়ায় বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, পাঁচ বছরে এসব ব্যাংকে এসেছে অনেক পরিবর্তন। গত ২০১৮ সালে চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল ৩ হাজার ৯৪০ কোটি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০২২ সালে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮০ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায়। হিসাব বলছে, চতুর্থ প্রজন্মের এসব ব্যাংকের মধ্যে কয়েকটির ঋণ বিতরণের চেয়ে খেলাপি ঋণের প্রবৃদ্ধির হার বেশি।

সবশেষ তথ্যমতে, ২০২৩ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে এই ৯টি ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮২ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৬ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। তথ্যমতে, পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। কারণ ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৩ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। এটি তাদের বিতরণ করা মোট ঋণের ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ।

একই সময়ে (মার্চ প্রান্তিক শেষে) ইউনিয়ন ব্যাংক বিতরণ করে ২২ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৮৫২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। মেঘনা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ ৩ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ৩৫৫ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ। মিডল্যান্ড ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৩৩ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ১৬৯ কোটি টাকা বা মোট বিতরণ করা ঋণের ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। সাউথ বাংলা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ৩৯৭ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।

এ ছাড়াও, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৬৭২ কোটি টাকা বা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার ৮২ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ বা ৩৫৫ কোটি টাকা।

উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। শুধু তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। আর বিগত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নতুনত্বের নামে বাজারে আসা ব্যাংকগুলোতে আসলে কোনো নতুনত্ব নেই। যেসব এলাকাতে ধনাঢ্য মানুষ বেশি, সেসব এলাকাতে শাখা খুলেছে তারা। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকাতে তাদের শাখা দেওয়ার কথা ছিল। অন্যান্য ব্যাংকের মতো শিল্প গ্রুপগুলোর পেছনে দৌড়ায় ওরা।

তিনি আরও বলেন, ‘এসব ব্যাংক ঋণও দেয় অন্যান্য কনভেনশনাল ব্যাংকের মতোই। কিন্তু নতুন উদ্যোক্তাদের মাঝে বেশি বেশি ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া উচিত ছিল। সরকারি বড় বড় সংস্থার পেছনে এফডিআর পাওয়ার জন্য ঘুরতে থাকা ইনোভেটিভ (উদ্ভাবনী) ব্যাংকিংয়ের পরিচয় বহন করে না। কিছু কিছু ব্যাংক আছে, যাদের পরিচালকদের সঙ্গে উচ্চমহলের বিশেষ কিছু ব্যক্তির যোগাযোগ আছে। তাদের ইচ্ছামতো এসব ব্যাংক পরিচালিত হয়।