প্রকাশিত : সোমবার, ১৪ আগস্ট ২০২৩

Share This News

পাকিস্তানে নির্বাচন নিয়ে সংশয় কেন

পাকিস্তানে নির্বাচন নিয়ে সংশয় কেন

‘প্রধানমন্ত্রী থেকে জেলবন্দি’ এমন একটি বাংলা সিনেমার কথা যদি কল্পনা করা হয় এবং এর কাহিনী যদি কাউকে লিখতে হয় তাহলে বর্তমান বিশ্বে পাকিস্তানের কথাই চলে আসবে। পাকিস্তানের লেখক ও সাংবাদিক জাহিদ হুসাইনের মতে, দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে এই প্রথা চলে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে কোনো প্রধানমন্ত্রী তার পাঁচ বছরের মেয়াদও পূর্ণ করতে পারেননি। কারণ পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর একটা বড় প্রভাব রয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার দেশটির সদ্যবিদায়ি প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও স্বীকার করেছেন যে, সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছাড়া সরকার চালানো সম্ভব নয়। তার এই স্বীকারোক্তির দুই দিনের মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের নাম সময়মতোই হয়েছে। তারপরও দেশটির আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচন যে সময়মতো হবে না সেটাই বিভিন্ন বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। যদিও নির্বাচন আয়োজনে প্রধান বাধা ইমরান খানকে কারাগারে শেষ পর্যন্ত পাঠানো হয়েছে।

নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের কয়েকটি কারণ

পাকিস্তানের পার্লামেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে গত ৯ আগস্ট বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সংবিধানের ২২৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে, ‘জাতীয় পরিষদ কিংবা প্রাদেশিক পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরের ৬০ দিনের মধ্যে, যদি না পার্লামেন্টকে মেয়াদ শেষের আগেই ভেঙে দেওয়া হয়।’ অনুচ্ছেদ ২২৪ (২) অনুসারে, মেয়াদ শেষের আগেই পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন পার্লামেন্ট ভাঙার ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে বাধ্য। এরপরও নির্বাচন নিয়ে সংশয় রয়েছে যে কারণে।

প্রথমত: নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, দেশটিতে জনশুমারির ভিত্তিতে নির্বাচনি আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, ‘জনশুমারি শেষ হলেই নির্বাচন হবে। এ জন্য চার মাস সময় দরকার হবে। ফলে নির্বাচনটি আগামী বছর পর্যন্ত বিলম্বিত হতে পারে’। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও সাংবাদিকদের সম্প্রতি বলেছিলেন যে, এ বছর নির্বাচন নাও হতে পারে। কারণ নতুন জনশুমারি ছাড়া নির্বাচনের আয়োজন করলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

দ্বিতীয়ত: ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন বিরোধীদল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) মনে করছে, মূলত তাদের নিশানা করেই নির্বাচন আইন সংশোধন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তারা মনে করছে, পিটিআই যাতে ফের ক্ষমতায় ফিরতে না পারে, সে জন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

দেশটিতে গত সপ্তাহেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেফতার করা হয় এবং আদালতের রায়ে তার কারাদণ্ড হওয়ায় তিনি পাঁচ বছরের জন্য রাজনীতিতে অযোগ্য হয়ে গেছেন। দেশটিতে এমন আলোচনা আছে যে, নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার মূল কারণ হলো ইমরান খানের জনপ্রিয়তা। ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ)-এর জোট নির্বাচনের জয়ের বিষয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়। এক সময়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও ইমরান খান এমনভাবে সেনাবাহিনীর বিরোধে জড়িয়েছেন—যা তার আগে কোনো রাজনীতিক করেননি। সিনিয়র বিশ্লেষক রাসুল বখশ রাইস এমনকি এটাও মনে করেন যে, গ্রেফতারের কারণেও ইমরান খানের জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে। ৭০ বছর বয়সি রাজনীতিক দাবি করেছিলেন যে, সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য হলো ‘তাকে বন্দি রেখে তার দলকে ধ্বংস করে দেওয়া’।

পাকিস্তানে সেই একই নিয়ম দেখা গেছে: পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে যেই চ্যালেঞ্জ করুক, এমনকি সেটা ইমরান খানের মতো আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হলেও তাকে সরে যেতে হবে। ১৯৭০ সাল থেকেই এটি হয়ে আসছে এবং এ তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হলেন ইমরান খান। সাবেক সিনেটর আফরাসিয়াব খাত্তাক বিবিসিকে বলেন, এখানে সমান্তরালভাবে দুটি সরকার কাজ করে। ‘অনুমোদনহীন ডি ফ্যাক্টো ফোর্স সবসময় সংসদীয় প্রক্রিয়ার ওপর খবরদারি করতে চায়। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সবসময়ই ক্ষমতাবান। কিন্তু তারা আরো ক্ষমতা চায়। যাতে করে তাদের অনুমোদিত কর্মকাণ্ড কেউ চ্যালেঞ্জ না করে সেটা রাজনীতিক, অধিকার কর্মী কিংবা সাংবাদিক যেই হোন না কেন’।

তৃতীয়ত: আর্থিক সংকট একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের সহযোগিতা সত্ত্বেও ব্যাপক মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে সেখানে। ফলে আর্থিক সংকটের দোহাই দিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হতে পারে। পিটিআইয়ের মুখপাত্র রউফ হাসান বলেছেন, দেশের অর্থনৈতিক নাজুক অবস্থাকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে নির্বাচন পেছানো হতে পারে। তবে তিনি এটিও বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট শক্ত অবস্থানে থাকলে সরকারের পক্ষে নির্বাচন পেছানো সম্ভব হবে না। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার সুপ্রিম কোর্টের প্রধানের পদে পরিবর্তন আসার অপেক্ষায়ও আছে।

চতুর্থত: গত সপ্তাহে পার্লামেন্টে দুটি ‘ড্রাকোনিয়ান ল’ উপস্থাপিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্যেই হলো, সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষমতা বাড়ানো। শতাব্দী প্রাচীন অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এর দুটি সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে যেটা মোটা দাগে আইএসআই এবং আইবি (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস লঙ্ঘনের অভিযোগ’ গ্রেফতারের ক্ষমতা দিবে। এছাড়া নতুন বিলটিতে এমন বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে যাতে কেউ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নাম প্রকাশ করলে তার তিন বছর জেল হবে।

এসব সংশোধনীর প্রস্তাব নিয়ে তীব্র হট্টগোল হয়েছে পার্লামেন্টে। পিটিআই ও পিএমএল-এন এর জোট সঙ্গীরা তড়িঘড়ি করে এসব ড্রাকোনিয়ান ল কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই পাশের তীব্র সমালোচনা করেছেন। জামাত-ই-ইসলামির সিনেটর মুশতাক আহমেদ বলেছেন, এ আইন গোয়েন্দা সংস্থাকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই তল্লাশি ও আটকের ‘ব্যাপক ক্ষমতা’ দিবে। এর প্রভাব পড়বে মানবাধিকার, ব্যক্তি অধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে নিয়মিতই বিরোধী রাজনীতিক, অধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের আটকের অভিযোগ ওঠে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টিতে প্রতি মাসেই বাড়ছে জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা তদন্তের জন্য কাজ সরকার সরকারি সংস্থার হিসেবে শুধু জুলাই মাসেই ১৫৭টি এ ধরনের ঘটনা সম্পর্কে রিপোর্ট হয়েছে। তথ্যসূত্র: বিবিসি ও ডন