প্রকাশিত : বুধবার, ১০ মে ২০২৩

Share This News

যীশুর জন্মভূমি

যীশুর জন্মভূমি

রুক্ষ শুষ্ক মরুভূমি। তারই ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল সেই অফুরন্ত করুণা ধারা, যার স্পর্শ থেকে মানবজাতি এখনও বঞ্চিত হয়নি। ইতিহাস আর খ্রীস্ট প্রভুর দেশ ইজ়রায়েলের ভ্রমণবৃত্তান্ত শোনালেন নূপুর বসু।



 

এই মরুপ্রদেশেই কুমারী মেরিমাতার কোল আলো করে আর্বিভাব ঘটে প্রভু যীশু খ্রীস্টের। হ্যাঁ, আমি সেই বিখ্যাত গোশালা দেখতে চলেছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী, অক্টোবরের এক আবছায়া বিকেলে,জর্ডানের রাজধানী আমানে আমাদের বিমান অবতারণ করল। পরদিন ভোরবেলা বাসে করে ইজ়রায়েল বর্ডারের দিকে রওনা দিলাম। কিং হুসেন ব্রিজ, যা স্থানীয় লোকদের কাছে অ্যালেন বাই ব্রিজ নামেও খ্যাত, সেই সেতু ধরে বর্ডার পার হলাম। ইজ়রায়েল এমন একটি দেশ, যার ভিসা পাসপোর্টে স্ট্যাম্প করা থাকলে কয়েকটি মুসলিম দেশে প্রবেশাধিকার মেলে না। তাই পেপার ভিসা সঙ্গী করে পাড়ি দিয়েছিলাম মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশে। বর্ডার পার হয়ে বাস পরিবর্তন করলাম। ঝাঁ চকচকে যানের সঙ্গে তরুণ যুবা সুপুরুষ গাইড, য়োহান। ঢেউ খেলানো গৈরিক পথ দিয়ে বাস ছুটে চলল নাজ়ারেথের পথে। মরুভূমির দেশে সবুজের বড় অভাব। রুক্ষ শুষ্ক, মনটা কেমন শিরশির করে ওঠে। বাস থেকে নেমে, হোটেল ঘরে পৌঁছেই গা এলিয়ে দিলাম নরম গদিতে। মনে ইতিমধ্যেই রোমাঞ্চ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। একসময় খুব আগ্রহ ভরে দেখতাম ‘বেনহুর’ কিংবা ‘টেন কমেন্ডমেন্টস’-এর সেই সব অজানা প্রেক্ষাপট। আর এখন একেবারে সশরীরে উপস্থিত সেই ইতিহাসের দেশে। রঙীন সেইসব কল্পনার জাল বুনতে বুনতেই ঢলে পড়লাম ঘুমে।

পরদিন সকালে বাসে উঠেই য়োহান আমাদের সারাদিনের ভ্রমণসূচির বিস্তারিত বিবরণ দিল। সূচির প্রথমেই ছিল বহু আলোচিত ‘গোলান হাইটস’, সুবিশাল লেক কিনারেট ঘিরে ছাইরঙা পর্বতশ্রেণী। প্রথমে দেখলাম জর্ডান নদী, যেখানে যীশুকে ব্যাপটাইজ় করা হয়েছিল। বহু লোক সেখানে এক কোমর জলে দাড়িয়ে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করছে এবং মাঝেমাঝে ডুব দিচ্ছে। এরপর গাইড একে একে দেখাল সি অফ গাইলির পাশ্ববর্তী সব দর্শনীয় স্থানগুলি। দেখলাম মাউন্ট বিটিচিউড। এখানেই একটি টিলার উপর বসে যীশু তাঁর প্রথম বাণী প্রচার করেছিলেন। সেখান থেকে গেলাম ক্যাপারনাম। ভগ্নস্তুপে ইউরোপীয় শৈলীর ছাপ এখনও সুষ্পষ্ট। কাছেই রয়েছে কানা, যেখানে যীশু জলকে সুরায় বদল করেছিলেন। এরপর দেখলাম ট্যাবঘা। পামের সারি এবং সবুজ ঘাসে ঢাকা বর্তমানের এই বাগানেই একদা ঘটেছিল বিখ্যাত ফিশ অ্যান্ড লোভস-এর ঘটনা। বাঁধানো মেঝেতে সুন্দর মোজাইকের নকশায় সেই কাহিনিই বর্ণিত। গাইলির সমুদ্রের বিস্তৃত ঘন নীল ও ভেজা ঠান্ডা বাতাস সঙ্গে নিয়ে পড়ন্ত বিকেলের হলদে আভায় নৌবিহার করে হোটেলে ফিরলাম। পরদিন যীশুর লীলাক্ষেত্র নাজ়ারেথ ছেড়ে জন্মভূমি জেরুজ়ালেমের পথে পা বাড়ালাম। পথে ভূমধ্যসাগরের তটবর্তী বাহাই গার্ডেন, জাফা শহর ঘুরে পৌঁছলাম ইজ়রায়েলের রাজধানী, তেলাভিভ। সেখানে মধ্যাহ্নভোজন সেরে আবার যাত্রা শুরু করলাম। বাস জেরুজ়ালেমে ঢুকতেই দেখলাম দু’পাশে উঁচু সাদা দেওয়াল। দু’পা অন্তর সশস্ত্র প্রহরীর শ্যেনদৃষ্টি। আসলে জেরুজ়ালেম শহরটি যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা জিউ আর ফিলিস্তানের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে বসবাসের জন্য। উঁচু -নিচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বাস ছুটে চলেছে। ফিলিস্তিনি এলাকা আরম্ভ হতেই য়োহান আমাদের বিদায় জানাল, কারণ এখানে তাঁর প্রবেশ নিষেধ।অবশেষে বাস পৌঁছল বেথেলহ্যামে। হ্যাঁ , যীশুর জন্মস্থান ও এই সফরের প্রধান আকর্ষণ। পলক ফেলতেই যেন বাইরের ছবি পালটে গেছে। সাজপোশাক, বাড়িঘর, সবকিছু। বাস থামল আমাদের বর্তমান ঠিকানা, হোটেল অ্যারারাতের সামনে। হোটেল মোটামুটি পরিষ্কার, কাজ চলে যায়। নৈশভোজ সেরে ঘরে ফিরে জানালার বাইরে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পাহাড়ের গায়ে সাজানো আলোর মালা। চূড়ায় একটি সোনা রঙের গোল গম্বুজওলা গির্জা। মাথায় ঝকঝক করছে ক্রুশ। এমন আধ্যাত্মিক পরিবেশে সারাদিনের ক্লান্তিতে, আর চোখ খুলে রাখতে পারলাম না।

পরদিন সকালের জলখাবারে পাহাড়প্রমাণ ফ্রায়েড এগস দেখে কান্না পেয়ে গেছিল। কিন্তু উপায় নেই। কোনওরকমে পেটে চালান করেই বেড়িয়ে পড়লাম যীশুর জন্মভূমির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। ‘মিল্ক গ্রোটো’-র কথা আগে কখনও শুনিনি। মা মেরি এখানে শিশু যীশুকে দুধ পান করিয়েছিলেন। গির্জার ভেতরে সাদা পাথরের এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ উঠেই একটি কোটরের মধ্যে মা মেরি কোলে যীশুর তৈলচিত্র। কিছুক্ষণ ক্যামেরায় শাণ দিয়ে চললাম পরবর্তী গন্তব্য যীশুর জন্মস্থান, চার্চ অফ ন্যাটিভিটির উদ্দেশ্যে। রাস্তার দু’পাশে দলে দলে পূণ্যার্থী চলেছে, হাতে জপের মালা, মুখে প্রার্থনা গান। সে এক অপূর্ব পরিবেশ। গির্জার ঠান্ডা পাথরের ভিতরে বিশাল দেওয়াল জোড়া অল্টার, তাতে বৃহদাকার রুপোর মোমবাতিদানি। এরই পাশ দিয়ে ঘোরানো পাথরের সিঁড়ি বেয়ে কিছুটা উঠেই, দেয়ালের গায়ে কোটরের মধ্যে একটি রুপোর তারা, মাঝখানে গোল গর্ত। এখানেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন সেই দেবশিশু। পিছনে অর্ধচন্দ্রাকার দেয়ালের গায়ে বহু প্রস্তরমূর্ত্তি। লাল আলোর অনেকগুলি লন্ঠন ঝুলছে। কাছেই একটি স্তম্ভের উপর ছেলেমেয়ের নামে মোমবাতি জ্বেলে বেরিয়ে এলাম গির্জা থেকে। পরবর্তী আকর্ষণ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু স্থান, ডেড সি। এখানকার জলের ঔষধি গুণ বিশ্ববিখ্যাত। কোনও কৃত্রিম সাহায্য ছাড়াই অনায়াসে এই সাগরের জলে ভেসে থাকা যায়। মরা সাগরের অপার সৌন্দর্যে মন ভিজিয়ে, পুরনো জেরুজ়ালেমের আঁকাবাঁকা, পাথুরে রাস্তা ভিয়া ডলোরোসা দিয়ে পৌঁছলাম চার্চ অফ হোলি সেফালকারে। গির্জার বিশাল দরজা পেরিয়ে ডানদিকে লম্বা স্তম্ভের উপর গোল গম্বুজ ঢাকা একটি স্থান। গাইড জানালো এইখানে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল।

দেয়ালে আঁকা রয়েছে শায়িত যীশুর চিত্র, তাঁকে ঘিরে রয়েছেন মা মেরী, মেরী ম্যাগডালিন এবং তাঁর শিষ্যরা। পাশেই দেখলাম একটি সাদা মার্বেল পাথরের চাঁই, উপরে লালচে দাগ। শুনলাম ক্রুশ থেকে নামানোর পরে যীশুর দেহ এখানে রেখেই ধোয়ানো হয়েছিল। বাঁদিকের যে বিশাল স্তম্ভে যীশুর দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল, সেখানে মেরামতের কাজ চলছে। সারা গির্জা জুড়ে বিভিন্ন রকমের মণিমুক্তখচিত অসংখ্য মোমবাতিদানিতে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। গির্জাটা ভালভাবে ঘুরে ঘুরে দেখছি, এমন সময় গাইড তাড়া দিল। আজই আমরা ইজ়রায়েল ছাড়ছি। কিন্তু ওয়েলিং ওয়াল দেখা বাকি। পবিত্র মন্দির টেম্পল মাউন্টের চারপাশ ঘিরে রাজা হেরড এক দেওয়াল তৈরি করেছিলেন। তারই কিছু অবশিষ্টাংশ এখনও বর্তমান। দেওয়ালের সামনে প্রচন্ড ভিড়, কিন্তু কোনও ঠেলাঠেলি নেই। দেখলাম সার সার চেয়ারে বসে লোকেরা দুলে দুলে মন্ত্রপাঠ করছে। পাথরের দেয়ালের ফাঁকে কোথাও লম্বা ঘাস, তো কোথাও সাদা কাগজ গোজা। বুঝলাম এটা তাঁদের মানত করার ধরণ। একরাশ ভক্তি আর বিষ্ময়ের মাঝেই ইজ়রায়েল ছাড়ার মনবেদনা ঘন হয়ে এল। ইজ়রায়েল ছেড়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই জর্ডান বর্ডারে পৌঁছলাম। সত্যি, মরুভূমির দেশে শ্যামলিমার অভাব হলেও, ইজ়রায়েলের পরতে পরতে যেন লুকিয়ে রয়েছে আদি বিশ্বের ইতিহাস, ধর্মীয় ঐকতান। প্রাকৃতিক স্বভাবদত্ত রুক্ষতাও যে আমার মনের মণিকোঠায় চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য!

কীভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে ইজ়রায়েল যাওয়ার সরাসরি বিমান রয়েছে।

কোথায় থাকবেন

নাজ়ারেথ

ভিট্রেজ গেস্ট হাউস, যোগাযোগ: +৯৭২৪ ৬০১ ২১৩০, ডবল বেডরুমের ভাড়া শুরু ৪৩০০ টাকা থেকে।

আল মিউত্রান গেস্ট হাউস, যোগাযোগ: +৯৭২৪ ৬৪৫ ৭৯৪৭, ডবল বেডরুমের ভাড়া শুরু ৭০০০ টাকা থেকে।

বেথলহ্যাম

হোটেল অ্যারারাত: যোগাযোগ: +৯৭২২ ২৭৪ ৯৮৮৮, http://www.ararat-hotel.com/, ডবল বেডরুমের ভাড়া শুরু ৫৬০০ টাকা থেকে।

হোটেল রিচ লাক্সারি স্যুট, যোগাযোগ: +৯৭২৫০ ৮৪৪ ৪৭৪৪, ডবল বেডরুমের ভাড়া শুরু ৩৪০০ টাকা থেকে।

কখন যাবেন

ইজ়রায়েল ভ্রমণের আদর্শ সময় এপ্রিল থেকে অক্টোবর।