প্রকাশিত : বুধবার, ৩০ আগস্ট ২০২৩

Share This News

সেই অন্ধকার সেই বিভীষিকা: কবি মহাদেব সাহার আত্মস্মৃতি

সেই অন্ধকার সেই বিভীষিকা: কবি মহাদেব সাহার আত্মস্মৃতি

মুজিব আসছেন। স্কুল মাঠে দাঁড়িয়ে নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা দেবেন। ক্ষেতের আলপথ ধরে, পথের ধুলো পায়ে মেখে দলে দলে মানুষ ছুটছে তাকে দেখতে। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার বাতিঘর হয়ে যিনি পরিচিত হবেন বঙ্গবন্ধু নামে, তার বক্তৃতা শুনতে। সেই জনারণ্যে এক কিশোর কবি দাঁড়িয়ে। শাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা দীর্ঘ অবয়ব অসামান্য মুজিবকে দেখে সে অভিভূত হয়ে গেল। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল একটি সাধারণ ছন্দ মেলানো কবিতা, ‘তুমি আসিয়াছ ফুলজোড় তীরে ছায়াময় এই গ্রামে/ আমরা গড়েছি পাতার তোরণ মুজিব তোমার নামে।’ কবিতা পড়া শেষ হতেই হাত বাড়িয়ে সস্নেহে বঙ্গবন্ধু এই কিশোরকে বুকে টেনে নিলেন। মাথায় ও কপালে চুমু দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, ‘বড় কবি হও।’

একজন বাঙালি কবির জীবনে এরচেয়ে মধুর, গৌরবের ও সম্মানের স্মৃতি আর কী হতে পারে? হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির আশীর্বাদ পাওয়া সেই কবির নাম মহাদেব সাহা। তিনিই লিখেছেন ‘আত্মস্মৃতি ১৯৭৫ : সেই অন্ধকার সেই বিভীষিকা’।

৭৫-এর ১৫ আগস্ট কয়েকজন বর্বর ঘাতকের অস্ত্র বক্ষ বিদীর্ণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, বিদীর্ণ করে বাংলাদেশের হৃদয়। এর মাত্র পাঁচ দিন আগে ১০ আগস্ট সন্ধ্যার প্রাক্কালে মহাদেব সাহা তার জন্মদাতা বাবাকে হারিয়েছেন। কবি লিখেছেন, ‘এ বোধহয় নিয়তিরই বিধান, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে আমি প্রকৃতপক্ষেই পিতৃশোক পালন করব।’

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের নারকীয় ভয়াবহতাকে মহাদেব সাহা তুলনা করেছেন একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাতের সঙ্গে। কলঙ্কিত সেই পনেরোই আগস্টে খালি হয়েছিল বাংলার বুক। বাংলাদেশ সেদিন পেছন পায়ে পাকিস্তানের দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল। রাজধানী ঢাকায় নেমে এসেছিল ভুতুড়ে অন্ধকার। সন্ধ্যা হলেই কারফিউ, আতঙ্ক আর দুঃস্বপ্ন। ‘বাংলাদেশ বেতার’ রেডিও পাকিস্তানের অনুকরণে হয়ে গেল ‘রেডিও বাংলাদেশ’। নাম বদলে গেছে আরও অনেক কিছুর। এই বাংলাদেশেই নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল বঙ্গবন্ধুর নাম।

এই রকম এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপুষ্ট কবি মহাদেব সাহা প্রায় ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েন। খুব ভয়ে ভয়ে থাকেন, রাত-দিন ঘরে বসে জাতির পিতার মুখচ্ছবি আঁকেন বুকের পাতায়, কবিতার খাতায়। তিনি লিখলেন, ‘কবে থেকে শুরু হলো এতো দীর্ঘ দীর্ঘস্থায়ী রাত/ অন্ধকারবেষ্টিত সবাই,/ কেউ কি কোথাও জেগে নাই, বোন ভাই একা কি সদলে?/ শুধু কি জলপাই রঙের ট্রাক, কালো বুট।’

যদিও বইয়ের নাম ‘আত্মস্মৃতি ১৯৭৫’, তবে মহাদেব সাহার এই স্মৃতিকথা পঁচাত্তরে আটকে থাকেনি। বস্তুত তিনি বাংলাদেশের জন্মকালের স্মৃতিকথাই লিখেছেন এতে। কীভাবে তরুণ ‘মুজিব ভাই’ হয়ে ওঠেন বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার বাতিঘর, কীভাবে তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা বাঙালির চোখে বুনে দেন সাহস- সেসবই কাব্যিক ভাষায় আবেগীয় সুরে বয়ান করেছেন মহাদেব সাহা। সেই অর্থে এই বই কবির চোখে বঙ্গবন্ধুর জীবনীও বটে।

এই দেশ, দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে চেয়েছিলেন যিনি, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা বার্ষিকীতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমার প্রাণপ্রিয় বাঙালি ভাই-বোনেরা, আমাদের এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি উৎসবের লগ্নে দাঁড়িয়ে আসুন আজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি, বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলব। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার ফল ভোগ করবে। আমি ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী ও উন্নততর জীবন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’ এর আগে ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন রেসকোর্সে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। কান্না অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে আমার হুকুম প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়। ভাই হিসেবে। তোমরা আমার ভাই, আমি তোমাদের ভাই। আমাদের এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। মা-বোন কাপড় না পায়, যুবকরা কাজ না পায়।’

বস্তুত, বঙ্গবন্ধু বেকারমুক্ত, অভাবমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রয়াস নিলেন। চাইলেন বৈষম্যমুক্ত এক বাংলাদেশ। যেন গুটিকয়েক সুবিধাবাদী নয়, সকলেই ভোগ করে স্বাধীনতার ফল। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বিশ্ব দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক আর একদিকে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’

বাকশাল গঠন করলেন বঙ্গবন্ধু। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল নব্য-ধনীরা। পুঁজির মালিক বিত্তবানেরা নিজেদের কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য বাকশালের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগল। বিভ্রান্ত করতে থাকে সাধারণ মানুষকে। অনেকেই বুঝে না-বুঝে শঙ্কিত হয়ে পড়ে, বিরুদ্ধেও চলে যায় কেউ কেউ। অথচ বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন শোষণ, বঞ্চনা দূর করে সাধারণ মানুষের সার্বিক উন্নতি। এমনই অভিমত ব্যক্ত করেছেন কবি। তিনি প্রচ্ছন্নভাবে এই হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুঁজিবাদী বিশ্বের দিকে তর্জনী তুলেছেন। পাকিস্তানের অশুভ প্রেতাত্মা হয়ে বাংলায় পদচারণাকারীরা পাকি অশুভ জিঘাংসা পূরণ করতেই বুলেট ছুঁড়েছে বাংলাদেশের জাতির পিতার বুকে।

‘সেই অন্ধকার সেই বিভীষিকার’ বয়ান করতে গিয়ে শোকাবহ কবি আবেগমথিত ভাষায় তুল ধরেছেন জাতির পিতার আত্মত্যাগ ও বাঙালির প্রতি ভালোবাসা। এঁকেছেন বাঙালির সাহস, শৈর্য্য, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা। বাঙালির জাতির জীবনে সর্ববৃহৎ কলঙ্কের কাল পঁচাত্তরের স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে বারবার এলোমেলো হয়ে গেছেন কবি। তিনি নিজেই তা স্বীকার করেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন ও তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা লিখতে বসে আমি বারবার খেই হারিয়ে ফেলছি। এটি কোনো ইতিহাস নয়। আমি আমার অনুভূতি দিয়ে যা বুঝতে পেরেছি ঘটনার পাশাপাশি তা-ও সংযোজনের চেষ্টা করেছি। এ এক অন্তহীন বিষাদকাব্য।’

এই বিষাদকাব্য যেকোনো বাঙালির কাছেই সমাদৃত হওয়ার দাবি রাখে। আগস্টের ভয়াবহ ইতিহাসের ধারাবাহিকতা কিংবা পারম্পর্য রক্ষা করে স্মৃতিকথা লেখেননি কবি। গবেষক বা ইতিহাসবিদের শৃঙ্খলা নয়, তিনি গ্রহণ করেছেন কবিচিত্তের স্বাধীনতা। আর কে না জানে, কবিরা জগতের স্পর্শকাতর ও অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। তাই বাংলাদেশের জন্মক্ষণ, জাতির পিতার স্বরূপ কিংবা ভয়াল সেই ১৫ আগস্টের সময়কাল যারা অনুভব করতে চান তাদের জন্য একজন কবিই যথার্থ বয়ান রাখতে পারেন। কবি মহাদেব সাহা সেই কাজটি করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সেই প্রত্যুষের সূর্যোদয় গিয়েছিল/ সহস্রযুগের কালো অন্ধকার ঢেকে/ কোটি কোটি চন্দ্রভুক অমাবস্যা তাঁকে গ্রাস করেছিলো/ রাত্রির চেয়েও অন্ধকার ছিল সেই অভিশপ্ত দিন।’ লিখেছেন, ‘মৃত নয়, দেহ নয়, দেশ শুয়ে আছে/ সমস্ত নদীর উৎস হৃদয়ের কাছে।’ বাংলায় যতদিন নদী বয়ে যাবে, মহাদেব সাহার এই অশ্রুময় আত্মস্মৃতি বাঙালির হৃদয়ে রবে।  

বই- আত্মস্মৃতি ১৯৭৫ : সেই অন্ধকার সেই বিভীষিকা

লেখক- মহাদেব সাহা