প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

Share This News

চীনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন

চীনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন

সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সংকটে আছে চীন। দেশটির অর্থনীতি এখন স্থবির। এই স্থবিরতা দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এজেন্ডার সামনে একটি স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

চীনের অর্থনীতি পুনরুত্থারের জন্য শি জিনপিংয়ের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি দেশটির শাসনব্যবস্থায় যেসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করছেন তার থেকে কিছু বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ তাকে ত্যাগ করতে হবে।

বর্তমানে চীনের জনগণ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। দেশটিতে স্থবির বেসরকারি বিনিয়োগ। চীনের বড় বড় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মুখোমুখি। দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের আঞ্চলিক সরকারসমূহের অবস্থাও ভালো নয়। তারা ব্যাপক পরিমাণ ঋণের বোঝায় জর্জরিত। এছাড়া দেশটিতে তরুণদের বেকারত্বও বেড়েই চলছে। সবমিলিয়ে চীনে এখন অর্থনৈতিক বিপর্যয় চলছে যা শি জিনপিং সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। এক দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা শি জিনপিংয়ের এজেন্ডার সামনে এটি একটি স্থায়ী ও কণ্টকময় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

চীনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ব্যাপারে এশিয়া সোসাইটির সেন্টার ফর চায়না অ্যানালাইসিসের ফেলো নীল থমাস বলেছেন, ‘চীনের অর্থনীতির জন্য এটি একটি বড় অনিশ্চয়তার মুহূর্ত। শি জিনপিংকে চীনের অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক সকল বিষয়কে সংশোধন করতে হবে।’

এ বছরের শুরুর দিকে শি জিনপিং তৃতীয় মেয়াদে চীনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বছরের শুরুতে তিনি করোনা মহামারিকে অতিক্রম করে দেশটির ব্যবসাখাত পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। যদিও দেশটিতে আবাসনখাতে লেনদেন কমে গিয়েছে তবুও তিনি ঋণে জর্জরিত চীনের আবাসন খাতকে নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

তবে শি জিনপিং এখন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। চীনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে তাকে দেশটির মানুষের ব্যক্তিগত ব্যবসায় আরও স্বাধীনতা দিতে হবে। একইসঙ্গে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের আঞ্চলিক সরকারগুলোকে আর্থিক সহায়তাও দিতে হবে। আর তার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য চীনে নতুন কর প্রবর্তনের মতো কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

চীনের অর্থনৈতিক সমস্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো দেশটির আবাসন খাতে মন্দা। দেশটিতে বাড়ি ও ফ্ল্যাট বিক্রি কমে গেছে। এ খাত গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি ছিল। কিন্তু এ খাতের সঙ্গে জড়িতরা দেশটির বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছেন, যা চীনের অর্থনীতিতে ভয়াবহ সংকটের সৃষ্টি করেছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দেশটির আবাসন খাত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীনে পুঁজির বিশৃঙ্খল সম্প্রসারণ এড়াতে ব্যক্তিগত পুঁজির ওপর লাগাম টানার চেষ্টা করেছিলেন। তবে দেশটির অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য বেসরকারি উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারীদের সুবিধা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পুঁজির ওপর টানা লাগামকে শিথিল করতে হবে।

এদিকে চীনে আবাসন খাতের মন্দা দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের আঞ্চলিক সরকারের ওপরেও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে। কেননা দেশটির আঞ্চলিক সরকার জমি ক্রয়-বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের ওপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দেশটির আঞ্চলিক সরকারকে হয় কেন্দ্রীয় সরকার আরও রাজস্ব সংগ্রহের উৎস দিক অথবা আঞ্চলিক সরকারকে কিছু ব্যয়ের বোঝা থেকে মুক্তি দিক।

এ ব্যাপারে বেইজিংয়ে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন ডেপুটি চিফ অব মিশন এবং কোহেন গ্রুপের সিনিয়র উপদেষ্টা ডেভ র‌্যাঙ্ক বলেছেন, ‘শি জিনপিং দেশের শাসনব্যবস্থাকে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পছন্দ করেন কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে যে পরিবর্তনগুলো আনতে হবে সেসব জায়গায় শি জিনপিংকে অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হবে। আর চীন এই সংকট থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো লোকদের গন্ডিও খুব ছোট।’

এদিকে সম্প্রতি চীনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা হংকংয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী লিউ মন হং এর একটি প্রবন্ধ প্রচার করেছেন। সেই প্রবন্ধে লিউ মন হং চীনের অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য শি জিনপিংয়ের ওপর দায় চাপিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘চীনের এই অর্থনৈতিক সমস্যার মূল দেশটির রাজনীতির মধ্যে নিহিত রয়েছে।’

চীনের সাবেক এক অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ‘চীনের অর্থনীতির স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য পুরোনো পন্থাগুলি আর কাজ করছে না।’ গত আগস্টে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি বলেছেন, ‘চীনের উদ্যোক্তাদের অস্থির প্রত্যাশা এবং আস্থাহীনতা দেশটিতে গৃহিত নতুন কার্যকলাপ এবং নতুন আধুনিক শিল্পের প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করছে।’

অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে বেইজিংয়ের শিক্ষাবিদ হু জিংডু চীনের উলফ ওয়ারিয়র কূটনীতির অবসান ঘটানোর জন্য শি জিনপিংকে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘উলফ ওয়ারিয়র কূটনীতির ফলে অনেক দেশের সঙ্গে চীনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।’

তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আপাতত শি জিনপিং তার বৃহত্তর কৌশলে বড় ধরনের কোন পরিবর্তন আনতে রাজি নন। কেননা বেইজিং প্রশাসন চীনের আঞ্চলিক সরকারগুলোর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনাকে এড়িয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে নাটিক্সিসের এশিয়া-প্যাসিফিকের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া হেরেরো বলেছেন, চীনের কেন্দ্রীয় সরকার দেশটির আঞ্চলিক সরকারগুলোর উপর ত্রাণকর্তা রূপে আবির্ভূত হোক এটা দেশটির নেতৃত্ব চায় না।

তিনি আরও বলেছেন, ‘চীনের অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য যা করা দরকার তা বাস্তবায়নের জন্য বেইজিং প্রশাসনকে আরও শক্তিশালী হতে হবে। আমরা চীনের কেন্দ্রীয় সরকারকে খুব শক্তিশালী বলে সমালোচনা করি। কিন্তু এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বেইজিং প্রশাসনকে আরো শক্তিশালী হতে হবে।’

এদিকে চীনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে পদক্ষেপ দেশটির গ্রহণ করা উচিত তা গ্রহণে বেইজিং প্রশাসন দেরি করে ফেলছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রাক্তন কর্মকর্তারা। খুব শীঘ্রই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করেন তারা।

লেখক: দ্য টাইমসের চীন প্রতিনিধি