প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

Share This News

বাংলাদেশে রিমোট সেনসিং প্রযুক্তির প্রসার, বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশে রিমোট সেনসিং প্রযুক্তির প্রসার, বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রযুক্তিক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সাফল্য নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ। স্যাটেলাইট যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গর্বের। স্যাটেলাইট মূলত রিমোট সেনসিং প্রযুক্তির মাধ্যমে কাজ করে। এই প্রযুক্তির সবচেয়ে বহুল ব্যবহার যোগাযোগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়। এ দেশে রিমোট সেনসিং তথা স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে আর এটি শুরু হয়েছিল বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে।

বঙ্গবন্ধু নিজেও অনেক প্রলয়ংঙ্করী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাক্ষী, মানববিধ্বংসী এসব দুর্যোগ বঙ্গবন্ধুর মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল বলেই ১৯৭০ সালে নির্বাচনের আগে পূর্ববঙ্গের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ সাইক্লোন গোর্কি ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে ৫ লাখ মানুষের সলিল সমাধি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের কাছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান এবং নির্বাচনের তারিখ পেছানোর অনুরোধ করেন। ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ লোকের প্রাণহানির জন্য বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের উদাসীনতাকে বহুলাংশে দায়ী করেন। আবহাওয়া উপগ্রহ থেকে ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া সত্ত্বেও যথাসময়ে সরকারিভাবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তাই স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে দুর্যোগ পূর্বাভাস, কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে আবহাওয়া চিত্র অবলোকন, প্রাকৃতিক সম্পদ জরিপ, কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত চিত্রের মাধ্যমে ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন বিশ্লেষণ এবং বায়ুমণ্ডলীয় গবেষণা করার নিমিত্তে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন- এ মহাকাশ ও বায়ুমণ্ডলীয় গবেষণা কেন্দ্র স্পেস অ্যান্ড অ্যাটমোসফিয়ারিক রিসার্স সেন্টার (এসএআরসি) প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু, ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত অটোম্যাটিক পিকচার ট্রান্সমিশন (এপিটি) গ্রাউন্ড স্টেশনটিকে এর আওতায় নিয়ে আসেন। ভূমি সম্পদ বিশ্লেষণে সক্ষম কৃত্রিম উপগ্রহ আবিষ্কারের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার আর্থ রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট (ইআরটিএস) নামে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে এটিকে বাংলাদেশ ল্যান্ডসেট প্রোগ্রাম (বিএলপি) নামকরণ করে ১৯৮০ সালে এসএআরসি ও বিএলপি এই প্রতিষ্ঠান দুটিকে একত্র করে স্পারসো গঠিত হয়।

বর্তমান বিশ্বে রিমোট সেনসিং একটি অতি-আধুনিক প্রযুক্তি হিসেবে বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে; স্থায়ী উন্নয়ন, গবেষণা, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও প্রতিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে খুব সহজেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় টেকসই উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় দ্রুত সেবা প্রেরণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করার ক্ষেত্রে রিমোট সেনসিং প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও রিমোট সেনসিং প্রযুক্তি প্রসারের অসংখ্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান। পরিবর্তনশীল, দুর্যোগপ্রবণ ও কৃষিপ্রধান এই ভূ-খণ্ডের ব্যবস্থাপনার জন্য এই প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ও প্রচার খুবই জরুরি। রিমোট সেনসিং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অতি-অল্প সময়ের মধ্যে দেশের আবাদি, অনাবাদি জমি, জলাশয়, মানববসতি, বনভূমির পরিমাণ, অবস্থা ও পরিবর্তন নির্ণয় করা যায়। খুব সহজেই স্যাটেলাইট থেকে গৃহীত ইমেজ ডাটার পিক্সেল বিশ্লেষণ করে কৃষিক্ষেত্রে কোন সময় কি ধরনের ফসল কোন জেলায় কী পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে তা নিরূপণ করা সম্ভব। একইভাবে মৎস্যসম্পদ, বনজসম্পদ, যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিবেশগত সমীক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহার জরুরি।

অবস্থানগতভাবে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ তাই দুর্যোগের পূর্বাভাস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগে দুর্গত এলাকার দুর্যোগের আগের ও দুর্যোগপরবর্তী অবস্থা বিশ্লেষণ করে দ্রুত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে দুর্গত এলাকায় কী ধরনের সহযোগিতা কতটি পরিবারের দরকার তা সহজেই রিমোট সেনসিং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে হিসাব করে দুর্যোগের ক্ষতি কমানো যায়। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে দেশে যেমন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি একদিকে কমেছে চাষযোগ্য জমি ও জলাভূমি, বাড়তি জনসংখ্যার বসতি ও কর্মসংস্থানের জন্য চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। চার দশক আগেও বাংলাদেশে সারা বছরে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার নাব্য নদীপথ ছিল কিন্তু বর্তমানে এটি কমে মাত্র ৫ হাজার কিলোমিটারে চলে এসেছে যা নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীপথ হারানোর পথে। তাই পরিবর্তনশীল এই ভূ-খণ্ডের পরিবর্তনের কারণ ও ফল বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে রিমোট সেনসিং প্রযুক্তি অত্যন্ত কার্যকর।

বর্তমান সরকারের ডিজিটাল দর্শনকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। ডিজিটাল বাংলাদেশের মূলমন্ত্রই হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার। গ্রাম হবে শহর পরিকল্পনাটির সাথে, বর্তমান আকাশ প্রযুক্তির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। গ্রামকে শহরের আবহে গড়তে হলে, নগরকেন্দ্রিক সুযোগ-সুবিধা গ্রামে নিশ্চিত করতে হলে সঠিক গ্রামীন সম্পদের টিকসই ব্যবস্থাপনার প্রতি নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রামীণ জলব্যবস্থাপনা, ভূমিব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ, তথ্যসেবা, সুপেয় পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবর্তনশীল পলিসমৃদ্ধ গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে এসব নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে ভূ-স্থানিক পর্যায়ে জিওস্পেশিয়াল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিস্তর গবেষণা ব্যতিত গ্রাম অঞ্চলে টেকসই উন্নয়ন বাস্তবিকভাবেই অসম্ভব।

উদীয়মান অর্থনীতির দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে চলেছে। এই অগ্রগতি ধরে রাখার পূর্বশর্ত প্রযুক্তিজ্ঞান সমৃদ্ধ দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি, টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন অতীব প্রয়োজন। উন্নত দেশ মানেই শিল্প সমৃদ্ধ দেশ, দেশের শিল্পকারখানা স্থাপন, শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠান, স্থানীয়করণ করার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা, যাচাই তথা স্থানিক ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের ক্ষেত্রে রিমোট সেনসিং প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের টেকসই উন্নয়নকে নিশ্চিত করবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ তিনটি প্রধান লক্ষ্যে পৌঁছানোর এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রথমত, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শেষ হবে ২০২৪ সালে। আর এই সময়টি হচ্ছে আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণের মাহেদ্রক্ষণ। এ সময়ের মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ ভাগের নিচে নেমে নিয়ে আসা, ৭৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ সব ক্ষেত্রে সমতাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, ২০৪১ সাল আমাদের উন্নয়ন ও অর্থনীতির পরিপক্বতার সময়। এ সময় প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বব্যবস্থা কেমন হবে সেটা অনেকটা অনুমেও। একই সময় বিশ্বে উন্নত দেশের পাশাপাশি অবস্থান করবে চরম উন্নত দেশ। তাই ২০২১-৪১ এই সময়ে আমরা কতটা যুগোপযোগী; অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিজ্ঞান সমৃদ্ধ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারব। তার ফল হিসেবে ২০৪১ সালে আমরা পাব উন্নত সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ। তৃতীয়ত, নদীশাসিত পরিবর্তনশীল এই ভূ-খণ্ডের ব্যবস্থাপনার জন্য বর্তমান সরকার শতবর্ষী বদ্বীপ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। ওই পরিকল্পনায় দেশের সমগ্র ভূ-ভাগকে যে ৮টি হাইড্রোলজিক্যাল ক্যাটাগরি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভিন্নতা ও তীব্রতার ভিত্তিতে যে ৬টি হটস্পটে ভাগ করেছে পরবর্তী যে কোনো ধরনের উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বদ্বীপ পরিবর্তনশীলতা ও পারিপার্শ্বিকতা বিশ্লেষণ করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের পরবর্তী প্রজন্মকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য প্রযুক্তি দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ গড়ে তোলার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে চলেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ দর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তা আরও বাস্তবমুখী ও টেকসই হচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের মাঝে তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষাদানের মাধ্যমে। কিন্তু, আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির যে, শিক্ষা অর্জন করছে তা প্রযুক্তি শিক্ষার একেবারে প্রাথমিক স্তরের এবং তা অনেকটা মুখস্তনির্ভর। প্রযুক্তি শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি, রিমোট সেনসিং, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম, ভূ-স্থানিক পরিবর্তনশীলতা পরিমাপ, ইন্টারনেট, রাডার, লাইটার, ড্রোন ও মহাকাশ প্রযুক্তির বিকাশে কৃত্রিম স্যাটেলাইট কীভাবে কাজ করে তা আমাদের শিক্ষার্থীদের জানার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে উন্নত বিশ্বের শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিজ্ঞানের সাথে আমাদের শিক্ষার্থীদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও মেশিন লার্নিংয়ের এ যুগে রিমোট সেনসিং প্রযুক্তির তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণে এ সংক্রান্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার প্রসার ঘটাতে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা।

বর্তমান স্মার্টফোনের যুগে একজন শিক্ষার্থী নিজের অজান্তেই এমন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, শিক্ষা জীবনে যদি তারা এসব প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা পায় তাহলে তারা বাস্তব জীবনে ওইসব প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে গুগল ম্যাপের কথা বলা যেতে পারে, গুগল এখন স্যাটেলাইট ইমেজ সম্পূর্ণ ফ্রি করে দিয়েছে। এতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা ঘরে বসেই বিভিন্ন স্থানের অ্যাবসুলেট লোকেশন, রোড নেটওয়ার্ক, ট্রাফিক ব্যবস্থা ইত্যাদি সেবা গ্রহণ করছে। এসব সেবার মূলে যে বিষয়টি কাজ করে তা হচ্ছে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি। রিমোট সেনসিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত শত শত স্যাটেলাইট পৃথিবীর ভূচিত্রাবলি হালনাগাদ করে চলেছে, ভূচিত্রাবলির মাঝে চলে আসছে নতুন রাস্তাঘাট, স্থাপনা, গাছপালা, নদ-নদীসহ যাবতীয় পার্থিব ফিচার। তাই রিমোট সেনসিং ও গ্লোবাল পজিশনিং সিসটেম, রাডার ও ড্রোন টেকনোলজির প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের মাধ্যমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত বিস্তার ঘটানো সময়ের দাবি।

মো. হিরু মিয়া: ইয়ুথ ম্যাপার, ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেনসিং অ্যান্ড জিআইএস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়