প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

Share This News

রেমিট্যান্স বাড়াতে কাঠামোগত সংস্কারের পথ খুঁজছে সরকার

রেমিট্যান্স বাড়াতে কাঠামোগত সংস্কারের পথ খুঁজছে সরকার

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:  রেমিট্যান্সে দুই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার পর দেশে  বৈদেশিক মুদ্রার যে প্রবাহ তৈরি হয়েছিল, তা ধরে রাখা যায়নি। ডলার সংকটের মধ্যে এই আয়ের গতি কমে গেছে। অথচ বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস প্রবাসী আয়। এমন প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্স বাড়াতে কাঠামোগত সংস্কারের পথ খুঁজছে সরকার। অর্থনীতিবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করে এ আয় বাড়াতে তথ্য-প্রমাণনির্ভর পরিকল্পনা নিয়ে কাজের তাগিদ দিয়েছেন। একই সঙ্গে বাজেট তৈরি ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি নিশ্চিতেও জোর দেন।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ২২ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ (এক ডলারে ১০৯.৫০ টাকা ধরে) ১১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকার কিছু বেশি। অবশ্য সোমবার থেকে ব্যাংকগুলো ১১০ টাকায় ডলার কিনে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ডলারের দর ৫০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা। আর আমদানিতে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা।

হিসাব বলছে, প্রতিদিন গড়ে ৪ কোটি ৭৯ লাখ ৫২ হাজার মার্কিন ডলার। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪৪ কোটি ডলার বা ১৫ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। যা তার আগের মাস থেকে প্রায় ১৬ কোটি ডলার কম। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ হবে জুলাই মাসের চেয়ে অন্তত ৫০ কোটি ডলার কম। এ ধারা অব্যাহত থাকলে জুন মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স কম হবে প্রায় ৭৫ কোটি ডলার কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর মাসের ২২ দিনে ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার এসেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৯ কোটি ১১ লাখ ৩০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মধ্যে এক ব্যাংকে এসেছে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৮০ হাজার ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৯২ কোটি ৯৮ লাখ ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৪১ লাখ ৫০ হাজার ডলার।

জুলাই মাসে ১৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলারের (১.৯৭ বিলিয়ন ডলার) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশীয় মুদ্রায় (এক ডলার সমান ১০৮.৫০ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকার বেশি। এটি ছিল আগের মাস জুনের তুলনায় ২২ কোটি ৬০ লাখ ডলার কম।

জুন মাসে রেকর্ড ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার (২.১৯ বিলিয়ন ডলার) প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। একক মাস হিসেবে যেটি ছিল প্রায় তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেকর্ড প্রবাসী আয় এসেছিল। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০২০ সালে হুন্ডি বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চসংখ্যক রেমিট্যান্স এসেছিল।

২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ২ হাজার ১৬১ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স। এটি এ যাবৎকালের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে করোনাকালে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। রেমিট্যান্স বাড়াতে সরকার কাঠামোগত সংস্কারের পথ খুঁজছে জানিয়ে সোমবার এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘সরকার দুই-শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার পর দেশে প্রবাসী আয়ের যে প্রবাহ তৈরি হয়েছিল, তা ধরে রাখা যায়নি। প্রতি বছর অনেক মানুষ কাজের জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। বর্তমানে এক কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন, কিন্তু প্রবাসী আয় সেভাবে বাড়ছে না।’

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের একটি হোটেলে আয়োজিত পাবলিক ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট বা পিএফএম সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী প্রবাসী আয় বাড়াতে দ্রæত প্রয়োজনীয় সংস্কার হাতে নেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এটি করা গেলে এক প্রবাসীর আয় দিয়েই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ অনেক সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

এ সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য আপনারা এভিডেন্স বা তথ্য-প্রমাণনির্ভর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করুন। মাইক্রো লেভেলে কেস টু কেস উদাহরণ দেখুন; তাহলে আমাদের প্রবাসী আয় ও রাজস্ব বাড়বে।’

বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে আয়োজিত এই সম্মেলনে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের গভর্ন্যান্স গেøাবাল প্র্যাকটিস দপ্তরের ব্যবস্থাপক হিশাম ওয়ালি ও বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশপ্রধান (কান্ট্রি ডিরেক্টর) আবদুলায়ে সেক। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খান, মোহাম্মদ তারেক, ফজলে কবীর, মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশপ্রধান (কান্ট্রি ডিরেক্টর) আবদুলায়ে সেক বলেন, ‘পাবলিক ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট (পিএফএম) হচ্ছে দেশের সুশাসন কাঠামোর মেরুদÐ। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, পিএফএফের মাধ্যমে উন্নত পরিষেবা দেওয়া, দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা।’

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের গভর্ন্যান্স গেøাবাল প্র্যাকটিস দপ্তরের ব্যবস্থাপক হিশাম ওয়ালি বলেন, ‘অনেক সমস্যার সমাধান হচ্ছে সুশাসন। সুশাসনের কেন্দ্রে আছে পিএফএম। সরকারের পিএফএম কার্যক্রম দুর্বল থাকলে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও দুর্বলতা থাকে। সেজন্য সরকারকে স্থানীয় ও অন্য দেশের পিএফএম কার্যক্রমের সফলতা ও ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘কার্যকর পাবলিক ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্টের জন্য এই খাতে পেশাদারিত্ব তৈরি করা প্রয়োজন। একজন মানুষ সব কাজ করবেÑ এই ধারণা থেকে বের হয়ে একেক বিষয়ে একেকজন পারদর্শী হবেন, সেই লক্ষ্যে কাজ করা উচিত।’

সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্ট্রাটেজিক প্ল্যানিং বিভাগ থেকে অপারেশনাল প্ল্যানিং কার্যক্রম আলাদা করার পরামর্শ দিয়ে সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী জানান, ‘ভারতেও এমনটা করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সরকারের বাজেট তৈরি ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করায় জোর দিতে হবে।’

সম্পদ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়ে সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ তারেক বলেন, ‘সব সরকারি সংস্থায় অভ্যন্তরীণ বাজেট ও নিরীক্ষাব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।’

সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির বলেন, ‘আমলাতন্ত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থার যে কোনো পরিবর্তনের বিষয়ে এক ধরনের বিপরীত চিন্তা আছে। ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য এ ধরনের চিন্তা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন।’

এদিকে, খোলাবাজারে ডলারের দর বাড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডি আরও বেড়ে গেছে বলে মনে করেন অনেকেই। জনশক্তি রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে আড়াই শতাংশ প্রণোদনাসহ যা পাওয়া যায়, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালে তার চেয়েও ৫ থেকে ৬ টাকা বেশি পাওয়া যায়। সে কারণেই সবাই হুন্ডির দিকে ঝুঁকছে। আর এজন্যই ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে কম আসছে।

জানা গেছে, ওই ২২ দিনে ৭ ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছেÑ রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা বিডিবিএল, বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বা রাকাব। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে- বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, সিটিজেন্স ব্যাংক, বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া।