প্রকাশিত : শুক্রবার, ৮ মার্চ ২০২৪

Share This News

‘ইন্ডাস্ট্রি চায় আমাকে ক্যাটরিনার মতো দেখতে লাগুক, অথচ টাকা দিতে চায় না’

‘ইন্ডাস্ট্রি চায় আমাকে ক্যাটরিনার মতো দেখতে লাগুক, অথচ টাকা দিতে চায় না’

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নিজের ছোটবেলা এবং বর্তমান সময়ের নানা সংগ্রামের কথা তুলে ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন টালিউড অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মিমি বলেছেন, আমি ছোট জায়গার মেয়ে, জলপাইগুড়ির। এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ স্বপ্ন দেখত না। ওখানকার মানুষ জীবনকে অন্যভাবে বোঝে। দশটা-পাঁচটার চাকরি, পাড়ার আড্ডা, ভাতঘুম — এর মধ্যে জীবন ঘুরতে থাকে। এই গড়পড়তা ঘোরাঘুরিতে আমার সেই ছোট থেকেই দম বন্ধ হয়ে আসত। তখন পাশে দিদি। পড়াশোনায় মন, গান গায়, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত…। আর আমি রং কালো করি, কাবাডি খেলি, ব্যাডমিন্টনে পুরস্কার পাই। কেউ আসে না আমার খেলা দেখতে, জয় দেখতে। বাবাও না, মাও না। তাদের সব চিন্তার কারণ আমি। বড়দের কথা শুনি না। হাফপ্যান্ট পরে বাড়িতে থাকি।

বাড়ি বয়ে মাকে অনেকেই এসে বলে যায় এ ভাবে ‘মেয়ে’ তৈরি হলে তার বিয়ে হবে না। বাবা-মা বিপদে পড়বে। জানি না আমার খেলায় প্রথম হওয়া মেডেলগুলো কোথায়? আমার বাড়ির লোক কোনও দিন সে সবের খোঁজ করবে না। আমি আজ যদি খুঁজতে বসি সেগুলো আর পাব না।

সেই ছোট থেকেই আমার মনে হত এই জীবনকে এতটাই আলাদা করব যে আজ যারা আমায় অবহেলা করছে তারাই আমার জায়গা এক দিন বুঝতে পারবে। সব ফেলে আমি এক জনকেই শুধু বিশ্বাস করতাম, তিনি ঈশ্বর। যখন একা লাগত, আকাশের সঙ্গে কথা বলতাম। ছোট ছিলাম। মনে হত ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলছি। ঈশ্বর আমার জন্য পথ তৈরি করে দেবেন।

সেই পথের খোঁজেই কলকাতা শহরে আসা। বড় পিসির মেয়ের বিয়েতে প্রথম কলকাতা দেখেছিলাম। মাটির নীচে রেল যায়। শপিং মল। শহরের ঝাঁ-চকচকে দিকগুলো আমায় টেনেছিল। তখন বয়স কম হলে কী হবে? মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম, এখানেই থাকব। কলেজে পড়াশোনা করতে কলকাতায় যখন যেতে চাইলাম, মা বলেছিল, “জলপাইগুড়িতেই রিকশা ভাড়া লাগবে কলেজে যাতায়াতের, সেটা নিয়ে ভাবতে বসেছি।তুই সেখানে বলছিস কলকাতায় গিয়ে পড়াশোনা? অসম্ভব!”

অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল আমার জেদ। দুদিন খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বাড়ির লোক বাধ্য হয়েছিল। সেখানেও লোকের টিপ্পনী! ‘কলকাতার কলেজে পড়তে পারবি না, এখানকার কলেজে ফর্ম তুলে রাখ। সেই তো ফিরতে হবে।’

এর পর বাবার হাত ধরে কলকাতায় আসা। আমার ওপর শর্ত চাপানো হল, বড় পিসির বাড়ির কাছে যে কলেজ সেখানেই পড়তে হবে। একা ‘মেয়ে’ কলকাতা শহরে জলপাইগুড়ি থেকে পড়তে আসবে, সহজ কথা নয়!

মেয়েদের ক্ষেত্রে আসলে কিছুই সহজ নয়।

ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম কাজ ধারাবাহিকে। নাম ‘চ্যাম্পিয়ন’। আমার মতো অনেক নতুন মুখ। মনে আছে তখন একটাই সাজঘর। আমরা ছেলেমেয়েরা সাজছি। হঠাৎ তিন জন প্রতিষ্ঠিত পুরুষ অভিনেতা ওই ঘরে ঢুকে দুম করে আমাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে যাক তার পরে আমরা সাজঘরে ঢুকব।’’ আমরা সাজগোজ করা অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে গাছের তলায় বসে রইলাম। বাইরে তখন চল্লিশ ডিগ্রি। আজ বোধ হয় অভিনেত্রীদের এত বিরূপতা সহ্য করতে হয় না। এখন সবার ম্যানেজার থাকে। বাউন্সার থাকে।

শুধু সে দিন নয়, সারা জীবন নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে। ‘হবে না’। আমি হাল ছাড়িনি। এখন দেখি খুব দ্রুত মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। খারাপ লাগে। একটা সময় তো ছিল মিমি চক্রবর্তীকে গরম থেকে বাঁচার জন্য তোশকে জল ঢেলে শুতে হয়েছিল। তোয়ালে ভিজিয়ে রাখতে হত। ইন্ডাস্ট্রিতে আসার পরে লোকে বলেছিল, “গ্রামের মেয়ে। কোনো দিন অভিনয় হবে না।” আজ সেই মুখগুলো দেখি না।

আমার যা কিছু লড়াইয়ের পথ তা কেবল ‘মেয়ে’ বলেই মেনে নিতে হয়েছে, এটা আমি মানি না। এই লড়াই, সহ্য সব কিন্তু আমার স্বপ্নের জন্য। অন্য কারও জন্য নয়। তার জন্য যে ভাবে যা করার, শক্ত হয়ে করে গিয়েছি।

তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়েও নারী শিল্পী হিসাবে ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা পিছিয়ে। এই কথা গলা তুলে বলতে চাই। আজ যদি ইন্ডাস্ট্রির সব মহিলা শিল্পীরা একজোট হয়ে লিঙ্গ বিশেষে পারিশ্রমিকের বিভাজন নিয়ে সোচ্চার হত, তা হলে মেয়েদের কম পারিশ্রমিক দেওয়ার বিষয়টা হয়তো বন্ধ হত। এখানে লোকে বোঝেই না, এক হলে কাজ সহজ হয়। এই ইন্ডাস্ট্রিতে হয়তো দেখলাম এক জন আর এক জনের মুখ দেখছে না, ও মা! এক মাস পরেই দেখলাম দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরছে। আমি এই হিসাব বুঝি না। ওই জন্যেই পার্টি করা, হুল্লোড়ের মধ্যে তেমন যাই না। কাজ নিয়ে থাকি। কম কাজ করি। লিখি। বই পড়ি। 

আমার পোষ্যরা আমার জগৎ। আমার নিজের বন্ধুবান্ধব আছে, তারা আজীবন থাকবে। এই ইন্ডাস্ট্রিতে ভিন্ন স্বর থাকা ‘মেয়েদের’ কেউ পছন্দও করে না। কেন আমি চিত্রনাট্য নিয়ে এত প্রশ্ন করব? কেন? শুনতে হয়। বলিউডে কিন্তু এমন হয় না। টালিউডে টাকা কম জানি। তাই বলে নিশ্চয়ই দু’লাখ টাকায় কাজ করব না। আমার সহযোগী যারা সমাজমাধ্যম দেখে তারা সব সময় আমাকে জানায়, আমার মন্তব্য বাক্স ভরে আছে একটাই প্রশ্ন, ‘‘মিমির বিয়ে কবে হবে?’’ আজও এই প্রশ্নই সবচেয়ে বেশি শুনতে হয়।

আমি একমাত্র, যে বরাবর এর বিরোধিতা করেছি। কিন্তু লাভ কী! বিজ্ঞাপনের কাজে আমায় দশ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য লোকের হাত-পা শুকিয়ে গেলে অন্য আর এক জন মাত্র এক লাখ টাকায় সেই কাজ করে দেয়। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি চায় আমাকে বা আমাদের যেন ক্যাটরিনা কাইফের মতো দেখতে লাগে। অথচ সেই দেখতে চাওয়ার জন্য যে খরচ তার সিকিভাগ দিতে গেলেও লোকের যে কী কষ্ট হয়! মুম্বাইয়ে প্রযোজনা সংস্থা ক্যাটরিনার বিশেষ খাবারের খরচ পর্যন্ত জোটায়। আর এখানে? লোকে তো নিজেকে কম পয়সায় ঠিক করে রাখতেই পারবে না। আর তখন শুরু হবে ট্রোলিং। ‘মোটা মেয়ে’, ‘কালো মেয়ে’, ‘বুড়ি মেয়ে’।

আমি আজ এত কথা লিখছি, তাতে এমনটাও নয় যে আমি জীবনের সব সিদ্ধান্ত সঠিক নিয়েছি। এক সময় আমিও জীবনে একা থাকতে চাইনি। পরনির্ভরশীল ছিলাম। আবেগ ছিল। তার জন্য যা আঘাত পেয়েছি তা থেকে বেরোতেই অনেক সময় লেগেছে। আর নতুন করে ‘মেয়ে’ হিসাবে নয়, মানুষ হিসাবে কোনো আঘাত পেতে চাই না।

তবে ছোট থেকে প্রত্যেক নারীকে নিজের জন্য নিজেকে তৈরি হতে হবে। এই যে নারীরা স্বামীর হাতে মার খায়, তাদের শেখাতে হবে হাত উঠলে সেই হাত ভালবাসার হলেও সেটা গুঁড়িয়ে দিতে হবে। অসম্মান হলে চিৎকার করে বলতে হবে। টাকা রোজগার করে নিজের জন্য জমাতে হবে।

আমি জানি, বাবা-মায়ের পরে আমার তো কেউ নেই। জীবন একার… এ আমার অভিযোগ নয়, এ আমার শান্তি।