প্রকাশিত : বুধবার, ১৯ জুন ২০২৪

Share This News

গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কেন মিথ্যা বলছে

গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কেন মিথ্যা বলছে

মোহাম্মদ এলমাসরি

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্টনি ব্লিঙ্কেন দেশটির প্রস্তাবিত গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে গত বুধবার দোহায় সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানে তিনি সততার পরিচয় দেন নি। নিজের বক্তব্য পর্ব ও প্রশ্নোত্তর পর্বে ব্লিঙ্কেন বেশ কিছু কথা বলেছেন, যেগুলো পরিষ্কারভাবে মিথ্যা ও গভীরভাবে বিভ্রান্তিকর।

প্রথমত, ব্লিঙ্কেন জোর দিয়ে বলেছেন, ৩১ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে তিন পর্যায়ের যুদ্ধবিরতি চুক্তি ঘোষণা দিয়েছেন, সেটা একটা ‘ইসরায়েলি প্রস্তাব’ এবং ইসরায়েল তাতে পুরোপুরি সমর্থন দিয়েছে। প্রশ্নোত্তর পর্বে ব্লিঙ্কেনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র কি প্রস্তাবিত চুক্তিটি মেনে নেওয়ার জন্য ইসরায়েলকে চাপ দেবে? উত্তরে ব্লিঙ্কেন বলেছেন, এর কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, ইসরায়েল এর মধ্যেই সেটা গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু ব্লিঙ্কেন সত্য বলেননি।

প্রকৃতপক্ষে বাইডেনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দেওয়ার কারণ হলো, আগস্টে তিনি ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশন করতে চাইছেন। এর আগে তিনি তাঁর বিপর্যয়কর গাজা নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে মরিয়া। বাইডেন দাবি করেছেন, এটি ‘ইসরায়েলি প্রস্তাব’, কিন্তু সেটা সত্য নয়। কারণ হলো, বাইডেন তাঁর প্রস্তাব দেওয়ার পর দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু ইসরায়েল সরকারের পক্ষ থেকে কেউ চুক্তির ব্যাপারে কথা বলতে এগিয়ে আসেননি।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বরং চুক্তির বিরোধিতা করেছেন। দুই সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা স্পষ্টভাবে বাইডেনের খসড়া প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেছেন।

যাহোক, ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের জন্য হামাসকে দোষারোপ করা গাজায় গণহত্যার দোষারোপ থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করার আরেকটি মার্কিন প্রচেষ্টা। এ প্রেক্ষাপটে বাইডেন যে মিথ্যা বলবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

এ ছাড়া নেতানিয়াহু ও ইসরায়েল সরকারের অন্য সদস্যারা আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করেছেন। সেটা হলো, তাঁরা গাজা যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে চান। সম্প্রতি জাতিসংঘে ইসরায়েলি প্রতিনিধি রুট শাপির বেন-নাফতালি তাঁর দেশের অবস্থান আরও স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ নিয়ে ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে ‘কোনো পরিবর্তন ঘটেনি’, ‘ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে, যতক্ষণ হামাসের সামরিক ও সরকার পরিচালনার সক্ষমতা চূর্ণ না হয়’।

বেন-নাফতালি আরও বলেন, একটা স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইসরায়েল অর্থহীন ও অন্তহীন আলোচনায় জড়াতে রাজি নয়। ইসরায়েলের সাবেক শীর্ষ কূটনীতিক আলন লিয়েলের বক্তব্যেও ইসরায়েলি অবস্থান পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। তিনি বলেছেন, মার্কিনদের দেওয়া কোনো প্রস্তাব অবশ্যই গ্রহণ করবে না ইসরায়েল।

প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের শুরু থেকেই ইসরায়েল বলে আসছে, তারা ‘পুরোপুরি বিজয়’ চায়। ইসরায়েল বলছে, তাদের ‘পুরোপুরি বিজয়’ মানে হচ্ছে হামাসকে নির্মূল করা। কিন্তু আরও বাস্তব অর্থে এর অর্থ হচ্ছে গাজাকে পুরোপুরি ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া এবং ফিলিস্তিনিদের জোর করে মিসরে কিংবা জর্ডানে পাঠিয়ে দেওয়া। এ প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই বাইডেনের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতি সম্মান দেখানোর কোনো কারণ নেই ইসরায়েলের।

কারণ, চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে লড়াই স্থায়ীভাবে বন্ধের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাইডেনের প্রস্তাবে প্রথম পর্যায় শেষে ইসরায়েলকে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। বাইডেনের প্রস্তাবের শর্তে আছে, ইসরায়েল যদি প্রথম পর্যায় শেষ করে পরের পর্যায়ে যেতে রাজি হয়, তবেই চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায়টি শুরু হতে পারে। ইসরায়েল যদি দ্বিতীয় পর্যায়ে যেতে রাজি না হয়, তাহলে যুদ্ধবিরতির বিষয়টা সেখানেই শেষ হয়ে যাবে।

ব্লিঙ্কেন দ্বিতীয় মিথ্যাচার করেছেন হামাস ও প্রস্তাবে তাঁদের অবস্থান–সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে। সংবাদ সম্মেলনে ব্লিঙ্কেন দাবি করেন, বাইডেনের প্রস্তাবটি ৬ মে হামাসের দেওয়া প্রস্তাবের সঙ্গে ‘কার্যত অভিন্ন’। সংবাদ সম্মেলনে ব্লিঙ্কেন নানাভাবে হামাসকে দোষারোপ করে গেছেন। তিনি বলেছেন, হামাস আন্তরিক নয়, আগে যেসব শর্ত মেনে নিয়েছিল, সেগুলোসহ ক্রমাগত শর্ত পরিবর্তনের চেষ্টা করছে হামাস। কিন্তু এর সবকিছুই অসত্য।

প্রথমত, হামাসের ৬ মের প্রস্তাবটি বাইডেনের প্রস্তাব থেকে অনেকটাই ভিন্ন। সেখানে ইসরায়েলকে খেয়ালখুশিমতো চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, হামাসের প্রস্তাবে গাজার ওপর থেকে ইসরায়েলের অবৈধ ও শ্বাসরোধী অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ব্লিঙ্কেন বলেছেন, বাইডেনের প্রস্তাবে ‘অসংখ্য পরিবর্তন’ আনার কথা বলেছে হামাস।

কিন্তু হামাসের এই প্রচেষ্টা চালানোর কারণ হলো, তারা চেয়েছে বাইডেনের প্রস্তাবটি যেন তাদের প্রস্তাবের কাছাকাছি হয়। কারণ, হামাসের প্রস্তাবটিই প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে। কেননা, হামাসের দিক থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। গত ৩০ মে ফিলাডেলফিয়া করিডর ইসরায়েলি সেনারা দখলে নেওয়ার কারণে এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কিন্তু ব্লিঙ্কেন গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয় নিজের সুবিধামতো বাদ দিয়েই হামাসকে দোষারোপ করেছেন।

তৃতীয়ত, ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘গোটা বিশ্বই’ বাইডেনের প্রস্তাব সমর্থন করেছে; একমাত্র হামাসই প্রস্তাবটি মেনে না–ও নিতে পারে। কিন্তু এটা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বাধা তৈরি করেছে। এর সব কটিতেই হামাস ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন ছিল।

চতুর্থত, ব্লিঙ্কেন দাবি করেছেন, হামাস প্রস্তাবটি পাওয়ার পরও সিদ্ধান্ত জানাতে ১৪ দিন ঝুলিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তাঁর এ বক্তব্যও সত্য নয়। বাইডেন চুক্তির প্রস্তাবটি ৩১ মে ঘোষণা দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু লিখিত বিস্তারিত খসড়াটি ৬ জুনের আগে হামাসের কাছে আসেনি। হামাসের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে ১২ জুন। এর মানে পাঁচ দিন পর হামাস বাইডেনের চুক্তির খসড়ার ওপর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ফলে ব্লিঙ্কেনের ১২ দিনের অভিযোগটি বিভ্রান্তিকর।

যাহোক, ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের জন্য হামাসকে দোষারোপ করা গাজায় গণহত্যার দোষারোপ থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করার আরেকটি মার্কিন প্রচেষ্টা। এ প্রেক্ষাপটে বাইডেন যে মিথ্যা বলবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

 

 

মোহাম্মদ এলমাসরি দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের মিডিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক; আল-জাজিরা থেকে নেওয়া।