প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

Share This News

হারিয়ে যাওয়া শৈশব!

হারিয়ে যাওয়া শৈশব!

রেজুয়ান আহম্মেদ

শীতের রাত। ঢাকা শহরের রাস্তা নির্জন হয়ে গেছে। আমি বেইলি রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। হালকা কুয়াশার মধ্যে রাস্তার আলো মিটমিট করে জ্বলছে। এমন সময় একটা ছোট ছেলে, বয়স আট কিংবা নয় হবে, আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। দেখতে খুবই মায়াবী, চেহারায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছাপ। তার চোখের গভীরে যেনো কোনো এক হারানো স্মৃতির আলোড়ন। ছেলেটি নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার ভঙ্গিমায় অদ্ভুত এক অস্থিরতা।

আমি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। কেন জানি না, তাকে দেখে আমার খুব মায়া হল। হয়তো তার ওই শূন্য দৃষ্টিতে লুকিয়ে থাকা বেদনার গভীরতা আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ ছেলেটি ফিসফিস করে বলল, “ভাইয়া, আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে। কিছু খাওয়াবেন?”

আমি কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এত সুন্দর একটি ছেলেকে রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখাটা ছিল আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কী খেতে চাও?”

সে কণ্ঠে সরলতা নিয়ে বলল, “আপনি যা দিবেন, আমি তাই খাব।”

আমি তাকে পাশের ছোট্ট একটি হোটেলে নিয়ে গেলাম। আমার মন ছিল ভারাক্রান্ত, কিন্তু ছেলেটির সরলতায় অদ্ভুত এক প্রশান্তি পেলাম। আমি কিছু খাবার আনলাম। ছেলেটি চুপচাপ বসে রইলো, কিন্তু অদ্ভুতভাবে বেশি কিছু খেলো না। গুটিগুটি পায়ে কিছুটা খেয়ে ধীর কণ্ঠে বলল, “আপনাকে ধন্যবাদ।”

আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই শিশুটির গভীর বিষণ্নতা, তার কৃতজ্ঞতা আমার মনকে এক গভীর প্রশ্নের দিকে ঠেলে দিলো। নিশ্চয়ই সে কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তার শিক্ষিত ভঙ্গি, আর নিরহংকার কণ্ঠস্বর এটাই প্রমাণ করে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার মা-বাবা কোথায় থাকে?”

ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে শুরু করল। আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।

সে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমার মা-বাবা আমাকে ফেলে চলে গেছে। ওরা আলাদা হয়ে গেছে। মা অন্য জায়গায় বিয়ে করেছে, বাবা...”

কথাগুলো শুনে আমি স্তব্ধ। আমার মনে হলো পৃথিবীর সমস্ত বেদনাই যেন এই শিশুটির চোখে ধরা পড়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি তাদের সাথে কখনো দেখা করতে যাও না?”

ছেলেটি মাথা নাড়ল, “না। ওরা আমাকে দেখতে চায় না। আমি এখন একাই থাকি।”

“তুমি কোথায় থাকো?” আমি জানতে চাইলাম।

“ঠিক নেই। যেখানে জায়গা পাই, সেখানেই থাকি। কখনো ফুটপাথে, কখনো কারো ছাদের কোণে।”

আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। এই ছোট্ট ছেলে, যার বয়সটা স্কুলে যাওয়ার, খেলাধুলা করার, সে কি করে এত বড় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে? তার মনোবল আর দৃঢ়তা দেখে আমি নিজেকে ছোট মনে করলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি পড়াশোনা করো না?”

ছেলেটি মাথা নাড়ল, “আইডিয়াল স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়তাম। এখন তো আর স্কুলে যেতে পারি না।”

আমার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। এই ছোট্ট ছেলেটা কীভাবে এত কষ্টের ভেতরেও এত ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে? আমি ভাবলাম, কেমন বাবা-মা তারা, যারা নিজের সন্তানের দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি? শুধু নিজেদের সুখের জন্য তারা কীভাবে এই নিষ্পাপ শিশুটিকে ফেলে যেতে পারল?

আমি নীরব হয়ে ছেলেটির পাশে বসে রইলাম। কিছু বলতে পারছিলাম না। ছেলেটি তার চোখের পানি মুছে চুপ করে বসে রইল, যেন এই অভ্যাস সে অনেকদিন ধরেই রপ্ত করেছে। আমি গভীর শ্বাস নিলাম। এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি কখনো হইনি। বাবা-মা, যারা সন্তানের জন্য পৃথিবী ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে, তারা কীভাবে এমন অমানবিক হতে পারে?

কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, “তোমার আর কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই?”

ছেলেটি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, “জানি না। আমার মা-বাবা পালিয়ে বিয়ে করেছিল, আর কিছু জানি না।”

আমি তার কণ্ঠে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা আর নির্ভরতার অভাব টের পেলাম। এই ছোট্ট জীবনে সে কতটা কষ্ট, কতটা ত্যাগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা কল্পনা করাও আমার পক্ষে কঠিন ছিল।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি আমার সাথে যেতে চাও? আমি তোমার জন্য কিছু করার চেষ্টা করব।”

ছেলেটি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিতে এক ধরনের হতাশা আর অবিশ্বাস। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “ধন্যবাদ ভাইয়া। কিন্তু আমি জানি, কেউ আমাকে নিতে পারবে না। আমি একাই থাকবো, একাই চলবো।”

তার কথাগুলো আমার ভেতর গভীর দাগ কাটল। এই ছোট্ট ছেলেটা যে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা এত ভালোভাবে বুঝে ফেলেছে, তাতে আমার হৃদয় ভেঙে গেল। তাকে ছেড়ে আসতে কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তার অমোঘ সত্যের সামনে আমি অসহায়।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। ছেলেটিও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। আমি তার মাথায় হাত রেখে বললাম, “কখনো যদি আমাকে দরকার হয়, তুমি আমাকে খুঁজে নিও।”

ছেলেটি হালকা করে হাসল। তার হাসি আমার বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত শূন্যতা সৃষ্টি করল। সেই শূন্যতা থেকে বের হতে পারিনি। আমার সামনে দাঁড়ানো এই ছোট্ট ছেলেটি যেনো জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হয়ে রইল।

সেদিনের সেই দৃশ্য আমার স্মৃতিতে আজও জীবন্ত। ছেলেটির সেই শূন্য দৃষ্টি, তার কণ্ঠের বিষাদ আমার মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে। পৃথিবীতে এমন অনেক শিশুই আছে, যারা নিজেদের মা-বাবার ত্যাগের শিকার হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আমাদের সমাজ কি কখনো তাদের জন্য কিছু করতে পারবে? আমরা কি তাদের জন্য কোনো আশার আলো দেখাতে পারবো?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও পাইনি, কিন্তু সেই শিশুটির মুখ আজও আমার মনে আঁকা রয়ে গেছে। তার মতো কত শত ছেলেমেয়ে আমাদের এই শহরের কোণায় কোণায় হারিয়ে যায়, কেউ তা জানে না, কেউ তা বোঝে না।