প্রকাশিত : বুধবার, ১৪ জুন ২০২৩

Share This News

প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে

প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে

বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। সেইসঙ্গে বাড়ছে প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধের সংখ্যা। অপরাধ বাড়ায় মামলা দায়েরের পরিমাণও দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এজন্য দেশের সব থানায় স্থাপন করা হয়েছে সাইবার ডেস্ক। সাইবার আইনে দায়ের করা প্রতিটি মামলা তদন্তে সময় লাগছে কমপক্ষে এক বছর। ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের অভাবে এমনটি হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার বিভাগ ছাড়াও বিভিন্ন থানাও অনেক মামলার তদন্ত করছে।

পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিসের তথ্য মতে, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিস চালু করে পুলিশ। প্রতিবছর এই সার্ভিসের সহায়তা পাওয়া নারীর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। যাদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার নারী সাইবার বুলিং বা সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন। যোগাযোগকারী নারীর সংখ্যা গড়ে বছরে প্রায় ১২ হাজার। যাদের অভিযোগের বিষয়ে প্রযুক্তিগত ও আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

সূত্রটি বলছে, সাইবার বিভাগের সহায়তা নেওয়া নারীদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে আগে এর ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে বলা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাদের। এমনকি সাইবার ঝুঁকি সম্পর্কে না জেনে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের না জড়ানোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, না জেনে সাইবার জগতে প্রবেশ করলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ।

পুলিশ সদর দপ্তরের গবেষণায় দেখা গেছে, সাইবার ওয়ার্ল্ড মানুষের জীবনকে সহজ করেছে। পাশাপাশি প্রযু্িক্তর সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা প্রযুক্তিনির্ভর নানা অপরাধ করছে। এক সময় প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধের প্রায় শতভাগই শহরকেন্দ্রিক ছিল। বর্তমানে তা শহরের গণ্ডি পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে গেছে। কারণ গ্রামের মানুষের মধ্যেও প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। এতে করে অনেকেই সাইবার বুলিং বা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। শুধু ব্যক্তি বা সমাজ নয়, অনেক সময় রাষ্ট্রও এর শিকার হচ্ছে।

সূত্রটি বলছে, নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। এটা দিন দিন বাড়ছে। একজন নারী যখন সাইবার হামলার শিকার হন, তখন ওই নারী এবং তার পরিবারে কী ধরনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কাউকেই বোঝানো সম্ভব নয়।

সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের অভিযোগ বিশ্লেষণে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে হয়রানি করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। যা মোট অভিযোগের ৪৫ শতাংশের বেশি। নারীর প্রতি সাইবার স্পেসে অপরাধের ধরন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভুয়া আইডি থেকে মেসেজ বা তথ্য প্রকাশ করে হয়রানি, আইডি হ্যাক করে হয়রানি, ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং, মোবাইলে কল, আপত্তিকর ছবি, ভিডিও বা মেসেজ পাঠিয়ে হয়রানির ঘটনাগুলো ঘটেছে।

ভুক্তভোগী নারীদের বয়স পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এদের মধ্যে শতকরা ১৬ ভাগের বয়স ১৮ বছরের কম। শতকরা ৫৮ ভাগ ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সি। ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সি ভুক্তভোগীর সংখ্যা শতকরা ২০ ভাগ এবং ৬ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৪০ বছরের বেশি।

প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানে অভিযুক্তদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তবে অধিকাংশ ভুক্তভোগী পরবর্তীতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও লোকলজ্জার ভয়ে আইনগত পদক্ষেপ হিসেবে মামলা করা থেকে বিরত থাকেন। এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ ধরনের ভুক্তভোগীরা শুধু আইডি বন্ধ করে বা মেসেজ ডিলিট করে সমস্যা সমাধান করতে চান। ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাত্র ১২ ভাগ আইনগত ব্যবস্থা হিসেবে জিডি বা মামলা করেছেন। তাদের মধ্যে মাত্র ১৩ ভাগ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্ত করার পর অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. মনজুর রহমান বলেন, মানুষের মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার কারণে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক অপরাধ বাড়বে, এটিই স্বাভাবিক। প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধের শিকার হওয়াদের শতভাগ আইনগত সহায়তা দিতে প্রতিটি থানায় নারী ও শিশু ডেস্ক স্থাপনের মতো সাইবার ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা সেখানে মামলা করতে পারেন। থানা পুলিশ নিজেরা ওইসব মামলা তদন্ত করতে পারেন। আবার তদন্ত জটিল হলে পুলিশের সাইবার বিভাগের সহায়তা নিয়ে মামলার তদন্ত করে রিপোর্ট দেন।

সিআইডি প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া জানান, ঢাকায় পরীক্ষামূলকভাবে সাইবার থানা চালু করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। একই সঙ্গে ঢাকার প্রতিটি থানার পাশাপাশি দেশের সব থানায় সাইবার ডেস্ক রয়েছে। সাইবার আইনে কোনো মামলা দায়ের হলে সিআইডির তরফ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়। এছাড়া সিআইডির পৃথক পৃথক সাইবার টিম এ সংক্রান্ত মামলাগুলো তদন্ত করছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাইবার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ডিবির উত্তর ও দক্ষিণ নামে পৃথক দু’টি সাইবার ইউনিট রয়েছে। প্রতিটি ইউনিট বছরে দুই শতাধিক মামলার তদন্ত করে। সে হিসেবে দুই ইউনিট মিলে মামলার সংখ্যা ৪শ’। যেসব মামলা থানা পুলিশের পক্ষে তদন্ত করা সম্ভব হয় না, সেসব মামলা ডিবির সাইবার বিভাগের কাছে তদন্তের জন্য আসে। থানা পুলিশের কাছে সাইবার মামলা তদন্ত করার মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ না থাকার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

সম্প্রতি প্রতিটি থানার অনেক কর্মকর্তাকে সাইবার মামলা তদন্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যেসব মামলা থানা পুলিশ তদন্ত করতে পারে, সেসব মামলা অন্য কোথাও তদন্তের জন্য যায় না।

এসব বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার বিভাগের উত্তর জোনের উপকমিশনার মোহাম্মদ তারেক বিন রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার ইউনিটে প্রতি বছর দুই শতাধিক সাইবার সংক্রান্ত মামলা তদন্তের জন্য আসে। প্রতিটি মামলার তদন্ত শেষ করতে কমপক্ষে এক বছর করে সময় লাগে। কারণ ডিবির নিজস্ব কোনো ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব নেই। ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব পুলিশের মধ্যে শুধু সিআইডি আর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে আছে।

তিনি আরও জানান, সারা দেশ থেকেই সাইবার মামলার আলামতের ফরেনসিক টেস্টের জন্য সিআইডির ল্যাবরেটরিতে আসে। সেখানে অনেক বেশি চাপ থাকে। চাপ থাকার সে কারণে সিরিয়াল মেইনটেইন করে টেস্টগুলো হয়। এজন্য একটু বেশি সময় লেগে যায়। যেসব সংস্থা সাইবার সংক্রান্ত মামলা তদন্ত করে, তাদের নিজস্ব ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরি থাকলে স্বাভাবিক কারণেই মামলা তদন্তের সময় অনেক কম লাগবে। এতে মামলা জট কমবে। মামলার বাদী-বিবাদীর ভোগান্তির পাশাপাশি তদন্তকারী কর্মকর্তারাও অল্প সময়ে অনেক মামলার তদন্ত করতে পারবেন। যা বিচার ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করতে সহায়তা করবে।

সাইবার অপরাধের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সাইবার অপরাধ বাড়বে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ার কারণে মানুষ অনেক সুবিধা পাচ্ছেন। একই সঙ্গে অপরাধের ধরন পাল্টে গেছে। সেই দিক বিবেচনা করে বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন), ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং কমিশনের (এনটিএমসি) মধ্যে চুক্তি করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত বিষয়ে তারা পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। তারই ধারাবাহিকতায় বিটিআরসি কর্তৃক ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্ট্রার (এনইআইআর) সিস্টেম চালু করা হয়েছে। যা মোবাইল ফোন শনাক্ত করা সহজ করেছে। এতে করে ভবিষ্যতে প্রযুক্তিগত সমন্বয়ের মাধ্যম জনগণ ও রাষ্ট্রের অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

প্রসঙ্গত, দেশে বর্তমানে ১৪টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন করছে। সারা দেশের শতভাগ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বিস্তৃত রয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যবহার বেড়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানোসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। মূলত সাইবার জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেই সরকারের তরফ থেকে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান।