প্রকাশিত : রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪

Share This News

ছায়ার ওপারে!

ছায়ার ওপারে!

রেজুয়ান আহম্মেদ

রাত তখন প্রায় মধ্যরাত। নিস্তব্ধতা ভেঙে হালকা বাতাস শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ছে। দূরে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের ফিকে আলো আর মাঝে মাঝে পথচারীদের সরে যাওয়া পদশব্দ ছাড়া চারপাশে কোনো শব্দ নেই। কিন্তু এই নীরবতার মধ্যেই ফুটপাতের এক কোণায় শুয়ে আছেন রোকেয়া—শরীর জীর্ণ, মুখ শুকিয়ে ফাটা, এবং চোখের তলায় কালচে দাগ। মায়ের কোলে শুয়ে আছে তার পাঁচ বছরের ছোট্ট সন্তান, মেহের। মেহেরের নিষ্পাপ চোখগুলো এখনও পৃথিবীর কঠোর বাস্তবতাকে দেখেনি।

রোকেয়ার শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে, মৃত্যুর প্রান্তে পৌঁছে গেছেন তিনি। অনেকদিন ধরে খাবার নেই, চিকিৎসার অভাবে তার শরীর অসহায়। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রেখেও তার চোখে শুধু মেহেরকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্ট। তার অন্তরের কান্না ফুটে উঠছে চোখের জল হয়ে, যা তার সন্তানের মাথায় টপটপ করে পড়ছে।

মেহের কিছু বুঝতে পারছে না। মায়ের এই নিঃশব্দ কান্না কেন, তা তার ছোট্ট মন বুঝতে অক্ষম। সে মায়ের কপালে ছোট্ট হাত রেখে বলে, “মা, তুমি কাঁদছো কেন? আমি তোমার সাথে আছি, মা। তুমি ঠিক হয়ে যাবে।” তার নিষ্পাপ কণ্ঠে রোকেয়ার ভেতরে তীব্র বেদনা আর গভীর ভালোবাসা একসাথে বাজে।

রোকেয়া তাকে কিছু বলতে পারে না, শুধু চোখ বুজে ছোট্ট মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন, “মেহেরকে ছেড়ে গেলে সে কীভাবে থাকবে? এই নিষ্ঠুর সমাজে, এই ফুটপাতে?”

রোকেয়ার মন অতীতে ভেসে যায়। শৈশবের দিনগুলো যেন সিনেমার পর্দার মতো সামনে ভেসে উঠছে। সে ছিল গ্রামের মেয়ে। সাদামাটা জীবনের মাঝে ছিল অনেক স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো একের পর এক ভেঙে গেছে, কঠোর বাস্তবতার ধাক্কায়। বিয়ের পরই জীবনের কঠিন অধ্যায় শুরু হয়েছিল। স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায় অন্য একজনের সাথে, আর সে একাই লড়াই করে বেঁচে ছিল মেহেরের জন্য। মেহেরই ছিল তার জীবনের একমাত্র আলো।

কিন্তু এখন সেই আলোও তার হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে। মেহেরের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় তার বুকের গভীরে রক্তক্ষরণ করছে। তার মন বারবার প্রশ্ন করে, “আমি না থাকলে মেহের কী করবে? কে তাকে আগলে রাখবে? এই নিষ্ঠুর পৃথিবী কীভাবে তাকে বাঁচতে দেবে?”

রোকেয়া জানেন, তার সময় শেষ হয়ে আসছে। তার শরীর আর সাড়া দিচ্ছে না, মনে হচ্ছে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন তিনি। মেহের মায়ের হাত ধরে বসে আছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না তার মা চিরতরে তাকে ছেড়ে যেতে চলেছে। মেহেরের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে রোকেয়ার হৃদয় আরও ভারী হয়ে আসে। শেষবারের মতো মেহেরকে বুকে টেনে নেন তিনি, যেন সব ভালোবাসা আর আশীর্বাদ সন্তানের মধ্যে ঢেলে দিতে চান।

মেহের অবুঝের মতো মাকে বলছে, “মা, তুমি কথা বলছো না কেন? তুমি ভালো হয়ে যাবে, না?”

কিন্তু রোকেয়ার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। তার চোখে নীরব কান্না, আর সেই কান্না বলছে, “তুমি শক্ত থাকবে, মেহের। আমি তোমার পাশে না থাকলেও, তোমার ভেতরের শক্তি তোমাকে রক্ষা করবে।”

মধ্যরাতের নীরবতা আরও ঘনীভূত হয়েছে। বাতাসে কেমন একটা অদ্ভুত শূন্যতা। রোকেয়ার নিঃশেষিত নিঃশ্বাসের সাথে সাথে সেই শূন্যতা যেন আরও প্রকট হয়ে উঠল। মেহের মায়ের বুকে ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু রোকেয়ার চোখের আলো নিভে গেছে চিরতরে। তার মুখে অল্প হাসি, যেন মেহেরকে শেষবারের মতো দেখেই তিনি তৃপ্ত হয়েছেন।

ভোরের সূর্য উঁকি দিচ্ছে, চারপাশে আলো ছড়াচ্ছে, কিন্তু ফুটপাতের সেই কোণায় যেন চিরকালীন অন্ধকার নেমে এসেছে। মেহের জেগে উঠে বুঝতে পারে না যে তার মায়ের ছায়া তাকে চিরতরে ছেড়ে গেছে।

মেহের তখনও কিছুই জানে না। সে মাকে ডাকে, কিন্তু কোনো সাড়া পায় না। শিশুটির মন বুঝতে পারে না কী ঘটেছে। আশেপাশের মানুষ এসে তাকে কাঁদতে দেখে, কেউ একজন এসে তাকে তুলে নেয়। কিন্তু মেহেরের মন এখনও মায়ের দিকে পড়ে আছে। তার ছোট্ট চোখে ভয়, অসহায়ত্ব, আর মায়ের প্রতি ভালোবাসার এক অদ্ভুত মিশ্রণ।

মেহেরের জীবনে এই মুহূর্তেই সবকিছু বদলে গেছে। তার পৃথিবীর একমাত্র আলো নিভে গেছে। কিন্তু রোকেয়ার ভালোবাসা, তার আত্মত্যাগ মেহেরের জীবনের প্রতি পদক্ষেপে সঙ্গী হয়ে থাকবে। মেহের একদিন বড় হবে, তার মায়ের মতোই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হবে। কিন্তু সে জানবে, তার মায়ের ছায়া সবসময় তার ওপারে, তাকে আগলে রাখছে।

ফুটপাতের অন্ধকার আর দুঃখের গল্পের মাঝেও সূর্য নতুনভাবে উদিত হয়। মেহের হয়তো এখন একা, কিন্তু তার মায়ের ভালোবাসা তাকে সবসময় সুরক্ষা দিয়ে যাবে। সেই ছায়ার ওপার থেকেই রোকেয়া তার সন্তানের পাশে থাকবে, তার প্রতিটি যাত্রায় শক্তি হয়ে।

পৃথিবী কঠিন, নিষ্ঠুর, কিন্তু মেহেরের মায়ের ছায়া তাকে সাহস যোগাবে জীবনের প্রতিটি মোড়ে। ‘ছায়ার ওপারে’ এক নতুন জীবনের শুরু, যেখানে ভালোবাসা চিরকাল জীবিত থাকে, হারিয়ে যায় না।