প্রকাশিত : সোমবার, ২১ অক্টোবর ২০২৪

Share This News

আমরা কেমন মানুষ?

আমরা কেমন মানুষ?

মোসাম্মৎ কল্পনা—একটি নাম, একটি গল্প, একটি হাহাকার। বয়স মাত্র ১৩, অথচ জীবনের অঙ্কুরেই তার কচি হৃদয়ে নেমে এসেছে পাশবিক অত্যাচারের কালো ছায়া। কল্পনা আমার মেয়ে হতে পারত, আপনারও হতে পারত। কিন্তু কল্পনার জন্য কেউ রাজু ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়াবে না। তার জন্য কোনো শ্লোগান উঠবে না, কোনো ব্যানার উড়বে না। কল্পনার কান্না শোনা হয় না, কারণ সে এক নীরব প্রান্তরে আবদ্ধ, যেখানে তার দমবন্ধ স্বপ্নগুলো ম্লান হয়ে গেছে।

চার বছর আগে, যখন তার বয়স ছিল মাত্র নয়, তখন থেকেই তার ওপর শুরু হয় এই অমানবিক নির্যাতন। জিনাত জাহান আদর নামের এক নারীর কাছে সে ছিল যেন একটি নির্জীব পুতুল। শো-ব্রাশ দিয়ে পিটিয়ে তার সামনের পাটির চারটি দাঁত ফেলে দেওয়া হয়। হেয়ার স্ট্রেইটনারের উত্তাপে তার কোমল শরীরে ছাপ রেখে দেওয়া হয়েছিলো এমনভাবে, যা শুধু কল্পনার শরীর নয়, তার আত্মাকেও পোড়ায়। গরম পানি ঢেলে তার পায়ে যে পচন সৃষ্টি করা হয়, তা কেবল কল্পনার শরীরকেই ধ্বংস করছে না, বরং আমাদের সমাজের নৈতিকতাকেও দেখিয়ে দিচ্ছে কতটা পচে গেছে।

কল্পনা শুধু একটি মেয়ে নয়, সে আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি। তার শরীরের প্রতিটি ক্ষত, প্রতিটি ছ্যাঁকা আমাদের মানবতার ওপর এক একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। আমরা কি কল্পনার মতো মেয়েদের রক্ষা করতে পেরেছি? এই সমাজ কি আদৌ এই নিষ্ঠুরতার দায় এড়াতে পারে? কল্পনার নির্যাতন কি শুধুই তার নিজের, নাকি পুরো মানবজাতির ব্যর্থতার প্রতীক?

জিনাত জাহানের শাস্তি কী হবে, আমরা জানি না। হয়তো সে কিছুদিন কারাগারে থাকবে, হয়তো কিছুদিন পরেই সে আবারও সমাজে ফিরে আসবে, মাথা উঁচু করে। কিন্তু কল্পনা? সে তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না তার সেই সুন্দর, স্বপ্নময় শৈশবে। তার শৈশব কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তার জীবনের রঙ মুছে দেওয়া হয়েছে।

আমার যদি কিছু করার ক্ষমতা থাকতো, আমি নিশ্চিতভাবেই জিনাত জাহানের জীবনেও সেই একই চিহ্ন রেখে দিতাম। তাকে পঙ্গু বানাতাম, শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও, যেন সে কল্পনার প্রতিটি কান্নার মূল্য বুঝতে পারে। কিন্তু তাতে কি কল্পনা ফিরে পাবে তার হারানো শৈশব? তার সেই হাসি, যা ছিল একসময় মুক্ত ঝরনার মতো?

আমাদের এই সমাজে কল্পনারা বারবার জন্মায়, বারবার নিঃশেষিত হয়, আর আমরা নির্বিকার দাঁড়িয়ে দেখি। কেউ কল্পনার জন্য পথে নামে না, কেউ তার জন্য শ্লোগান তোলে না। আমরা শুধু দুঃখ প্রকাশ করি, কয়েকদিন পর ভুলে যাই, আর সেই সঙ্গে কল্পনাদের কষ্টের গল্পও ভুলে যায় সমাজ।

কিন্তু এই গল্প শুধু কল্পনার নয়। এটি আমাদের সবার। কল্পনার কান্না, তার নির্যাতন, আমাদের সবার হৃদয়ে একটি স্থায়ী ক্ষত হয়ে থাকা উচিত। হয়তো আমরা তার জন্য কিছুই করতে পারিনি, কিন্তু অন্তত তার যন্ত্রণার গল্প আমাদের মানবিকতাকে শিখতে বাধ্য করুক। কারণ, কল্পনা শুধু একটি নাম নয়, সে আমাদের বিবেকের একটি অন্ধকার অধ্যায়, যা আমাদের বারবার প্রশ্ন করে—"আমরা কেমন মানুষ?"