পথের ধারে বসে থাকা ছোট্ট ওমরকে দেখলে যে কারো মন ভেঙে যাবে। তার চোখের গভীরতা যেন এক অনন্ত সমুদ্র, যেখানে দুঃখের ঢেউগুলো থেমে নেই—নিঃশব্দে আছড়ে পড়ছে, আবার ফিরে যাচ্ছে। মাত্র আট কিংবা নয় বছরের শিশু, অথচ তার মুখে বয়সের ভার এতটাই স্পষ্ট যে মনে হয়, যেন সে পৃথিবীর সমস্ত ভার নিজ কাঁধে নিয়ে চলছে।
ওমরের মায়াবী মুখশ্রী আর ঝলমলে চুলের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নিঃসঙ্গতার মর্মান্তিক গল্প। কেউ ভাবতেও পারবে না, এই শিশুটির জীবনে এত বড় যন্ত্রণা রয়েছে। তার কোনো আপনজন নেই। বাবা-মা হারিয়ে গেছে অনেক আগেই, আর তখন থেকেই তার জীবন রাস্তায় রয়ে গেছে। এই ফুটপাথই তার ঘর, আর ধুলোমাখা মাটি তার বিছানা। কখনো পেটভরে খেতে পারে, কখনো খালি পেটে দিন কাটাতে হয়। ঠাণ্ডার কাঁপুনি রাতগুলো তার জন্য সবচেয়ে কষ্টের। পুরনো গেঞ্জি জড়িয়ে রাখে, যেন এই গেঞ্জিটুকু শীতের ভেতরে তার একমাত্র আশ্রয়।
একদিন ক্ষুধার তাড়নায় ওমর একটি দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্ষুধার জ্বালা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সে আর সহ্য করতে পারে না। চুপিচুপি দোকানে ঢুকে পড়ে, কাউকে না দেখে দ্রুত একটা পাউরুটি তুলে নিয়ে খেতে শুরু করে। কিন্তু পৃথিবী নিষ্ঠুর, দোকানদারের চোখ ফাঁকি দেওয়া ওমরের পক্ষে সম্ভব হয়নি। দোকানদার তাকে দেখতে পেয়ে প্রচণ্ড রেগে যায়।
"তুই চুরি করিস!" তার কঠিন কণ্ঠে ওমরের ছোট্ট শরীর কাঁপতে থাকে। মুহূর্তেই ভয়ে জমে যায় সে। দোকানদার তাকে পেটাতে শুরু করে। আঘাতে আঘাতে শিশুটির শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে যায়।
"ভাই, আমাকে মারবেন না," কাঁদতে কাঁদতে বলে ওমর, "আমি কাজ করে আপনার টাকা শোধ করে দেব। প্লিজ, আমাকে আর মারবেন না।" তার কণ্ঠে করুণ অনুরোধ, তবুও দোকানদারের মন গলে না।
“তুই একটা চোর! তোকে পুলিশে দিতে হবে। তোকে ছেড়ে দিলে আবার চুরি করবি।”
শরীরে সহ্য করার শক্তি আর অবশিষ্ট নেই, তবুও ওমর কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমার শরীর ভালো না। অসুস্থ হলে কে ওষুধ কিনে দেবে? আমার অনেক খিদা লাগছিল, তাই চুরি করেছি। আমার অনেক শীত লাগে, দয়া করে আমার গেঞ্জিটা ছিঁড়বেন না।”
দোকানদারের নির্দয় আঘাতে ওমর আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। ছোট্ট শরীরে সে সমস্ত কষ্টের ভার বয়ে বেড়াচ্ছে। চোখের জল তখন টপটপ করে পড়ছে, যেন তার ভেতর লুকিয়ে থাকা হাজারো দুঃখের সাক্ষী। তার কষ্ট কেউ শুনছে না, কেউ দেখছে না।
রাতে ফুটপাথে শুয়ে পড়ে ওমর। শীতের কামড়ে হাত-পা কাঁপছে, আর পুরনো গেঞ্জিটাকে আরও বেশি করে শরীরে জড়িয়ে ধরে সে যেন একটু উষ্ণতার খোঁজে। মনে পড়ে তার ছোটবেলার সেই উষ্ণ স্মৃতি—যখন তার মা তাকে গলা জড়িয়ে ধরে আদর করত, আর বাবা প্রতিদিন রাতে খাবার নিয়ে আসত। সেই স্মৃতিগুলো এখন যেন কোনো স্বপ্নের মতো মনে হয়।
কিন্তু এখন তার জীবন বাস্তবের এক নির্মম দুঃস্বপ্ন।
তবুও, ওমরের ভেতর জ্বলছে এক অদম্য আশা। এই পৃথিবী যতই কঠিন হোক, সে জানে, একদিন তার নিজের জন্য একটা ভালো জীবন গড়বে। যদিও এই পৃথিবীতে কেউ তাকে আপন করে নেবে না, তবুও তার ইচ্ছাশক্তি তাকে পথ দেখাবে। তার হৃদয়ে জমে থাকা সমস্ত কষ্টের মধ্যেও সে জানে, একদিন সে নিজের জন্য কিছু করবে।
পথশিশু ওমরের কাহিনী শুধু তার নিজের নয়, এটি একটি নিষ্ঠুর সমাজের প্রতিচ্ছবি। এখানে অনেকেই কষ্টে বেঁচে থাকে, অথচ তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। ওমরের জীবন যেন সেই নিঃসঙ্গ এবং অবহেলিত সমাজের এক নিদারুণ প্রতিফলন।
অবহেলার আলো তবুও পথ দেখায়, যতই মানবতার আলো নিভে যাক, হৃদয়ের অদম্য শক্তি কখনো নিভে না।