প্রকাশিত : শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

Share This News

অন্তিম কর্তব্য!

অন্তিম কর্তব্য!

আমাদের সমাজে প্রায়শই শোনা যায়, "সব পুলিশই ঘুষ খায়!" এই ধারণাটি যেন প্রতিটি পুলিশ অফিসারের প্রতি একধরনের অবিচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সত্যের ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। সব পুলিশ ঘুষ খায় না; অনেকেই আছেন যারা ন্যায়-অন্যায়, মানবতা এবং কর্তব্যের পথে অটল থাকেন। তেমনই একজন ছিলেন ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট আবুল হোসেন।

আবুল হোসেনের কর্মজীবন প্রায় শেষের পথে। আরও মাত্র এক বছর, তারপর অবসর। জীবনের প্রায় পুরোটা সময় দেশের বিভিন্ন জেলায় চাকরি করেছেন, এখন সাত বছর যাবত ঢাকায় কর্মরত। ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকা তার পক্ষে কখনো সম্ভব হয়নি, কারণ তার সীমিত আয়ে রাজধানীতে জীবনযাপন সম্ভব নয়। জামালপুরে স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে একাই ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় ডিউটি করেন। চাকরি শেষ হতে চলেছে, কিন্তু তার কর্তব্যপরায়ণতায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং রোজা তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, কোনো পরিস্থিতিতেই তিনি তা বাদ দেননি।

রমজান মাসের এক সন্ধ্যা। ঈদের আগের দিন, ঢাকার কাকরাইল মোড়ে প্রচণ্ড ট্রাফিক। গাড়ির চাপ এতটাই বেশি যে, ইফতারের সময় হলেও রাস্তার শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তাকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হচ্ছিল। আবুল হোসেন ক্লান্ত, তৃষ্ণায় তার ঠোঁট শুকিয়ে আসছিল। বুকের ভেতর চিন্তাগুলো ভারি হয়ে উঠছিল—এই ঈদে তিনি কীভাবে তার সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাবেন? দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, চিকিৎসায় বেতন ও ঈদ বোনাসের সবটুকুই ব্যয় হয়ে গেছে। বাড়ির জন্য কোনো কিছু কেনা তো দূরের কথা, ইফতারের জন্য নিজেও কিছু কিনতে পারেননি।

তবুও, তার মন ছিল ডিউটির উপর। ব্যক্তিগত কষ্টের কথা একপাশে সরিয়ে রেখে মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ, সামনে একটি গাড়ি ব্রেক ফেল করে ছুটে আসছিল। মুহূর্তের মধ্যে আবুল হোসেন বুঝে গেলেন, গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। সামনেই একটি বৃদ্ধ ভিক্ষুক মহিলা রাস্তা পার হচ্ছিলেন। তার বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীর দ্রুত সরার ক্ষমতা হারিয়েছে।

আবুল হোসেনের মনের ভেতর এক মুহূর্তের জন্যও নিজের নিরাপত্তার কথা আসেনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, দৌড়ে গিয়ে বৃদ্ধাকে সরিয়ে দিলেন। কিন্তু নিজে আর সরতে পারলেন না। গাড়ির প্রচণ্ড ধাক্কায় তার দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। রক্তে ভিজে গেল রাস্তা, আর তার নীরব জীবন শেষ হয়ে গেল।

কাকরাইল মোড়ের ব্যস্ত রাস্তায়, গাড়ির হর্ন আর মানুষের কোলাহলে কেউ টের পেল না কী ঘটল। আবুল হোসেনের দেহ পড়ে রইল রাস্তায়, কিন্তু তার ত্যাগের কাহিনি বাতাসে মিশে গেল। নিজের জীবনের বিনিময়ে এক অসহায় বৃদ্ধার প্রাণ রক্ষা করে তিনি অমর হয়ে গেলেন, কিন্তু সেই আত্মত্যাগের বিনিময়ে কেউ তাকে মনে রাখল না। তার জীবনের শেষ চিন্তাগুলো ছিল তার পরিবারের জন্য—"ছেলেমেয়েদের জন্য কিছুই দিতে পারলাম না," এই কষ্ট বুকে নিয়ে তিনি বিদায় নিলেন।

ঈদের সকালে জামালপুরে আবুল হোসেনের ছেলে-মেয়েরা হয়তো তাদের বাবার জন্য অপেক্ষা করবে। তারাও জানে, বাবা কখনোই ঈদে কিছু না কিনে ফেরেন না। কিন্তু সেই অপেক্ষা আর কখনোই পূরণ হবে না। তাদের বাবা, তাদের নায়ক, নিজের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

ঢাকার শহর আলোর ঝলকানিতে ভরা, কিন্তু সেই আলোতে আবুল হোসেনের জীবন আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। তার শেষ নিঃশ্বাসটি ছিল একান্ত মানবিকতার একটি নিদর্শন, যেখানে নিজের জীবনের বিনিময়ে তিনি প্রমাণ করলেন, সব পুলিশ ঘুষ খায় না; কিছু মানুষ এখনো বেঁচে আছেন যারা কর্তব্য আর মানবিকতাকে সর্বোচ্চ স্থানে স্থান দেন।

 সমাপ্তি