প্রকাশিত : সোমবার, ৩১ জুলাই ২০২৩

Share This News

আন্দোলনের কৌশল বদল বিএনপির

আন্দোলনের কৌশল বদল বিএনপির

সরকার পতনের এক দফা কঠোর আন্দোলনের কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে বিএনপি। আরও কিছুদিন নতুন জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে দলটি। আজ সোমবার রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসমাবেশ থেকে এ কর্মসূচির ঘোষণা আসবে। ধারাবাহিক আন্দোলনে এক দিনের বিরতি দিয়ে অভিন্ন কৌশলে রাজপথের শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে চায় দলটি।

মহাসমাবেশ থেকে আরও কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা থাকলেও সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে দলটি। আপাতত আরও জনসম্পৃক্ত সাধারণ সভা, সমাবেশ-বিক্ষোভ, মানববন্ধন, পদযাত্রার মতো কর্মসূচি দিয়ে নেতাকর্মীকে আরও চাঙ্গা করে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে চায় তারা। পাশাপাশি দেশি-বিদেশিদের জনমতও পক্ষে রাখতে চাচ্ছেন দলের হাইকমান্ড। এমনকি ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীর উপস্থিতি কম হওয়ায় দায়িত্বে থাকা নেতাদের নামের তালিকাও তৈরি করছে দলটি।

দলীয় সূত্র জানায়, বিগত কয়েক দিনের কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় ও দায়িত্বশীল নেতাদের ভূমিকারও চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন দলের শীর্ষ নেতারা। মহাসমাবেশে লক্ষাধিক লোকসমাগম ঘটলেও পরের দিন শনিবার ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল কম। ঢিলেঢালা, গরহাজির ও অনুপস্থিত নেতাদের সম্পর্কে দলের ভেতর চলছে আলোচনা-সমালোচনা। নিষ্ক্রিয় আর ব্যর্থ নেতাদের তালিকা করে তাদের চিহ্নিত করার তাগাদাও দেওয়া হয়েছে।

অবস্থান কর্মসূচিকে আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট বিবেচনা করা হলেও গুটিকয়েক নেতার অবহেলা আর ব্যর্থতায় তা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। এ ছাড়া কর্মসূচিতে নেতাদের সমন্বয়হীনতাও ভুগিয়েছে নেতাকর্মীকে। এসব কাটিয়ে উঠে তার পর এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন দলের বেশির ভাগ নেতাকর্মী।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সমকালকে জানান, তারা একটি শক্ত ফ্যাসিবাদী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। এটা এত সহজ বিষয় নয়। অনেক রক্ত ঝরাতে হচ্ছে, অনেক প্রতিরোধ মোকাবিলা করতে হচ্ছে নেতাকর্মীকে। এটা একটা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। সেখানে কৌশলগত কারণে কখনও সামনে যেতে হয়, আবার কখনও পিছিয়েও আসতে হয়। দিন তারিখ দিয়ে আন্দোলন হয় না। তবে তারা এক দফার আন্দোলন সফল করতে খুব দ্রুত সময়ে কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।

গত ১২ জুলাই এক দফা আন্দোলন নতুন মাত্রায় শুরুর পর ১৮ ও ১৯ জুলাই মহানগর ও জেলা সদরে পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপে গত শুক্রবার ঢাকায় বড় মহাসমাবেশ করে দলটি। সেখান থেকেই ঘোষণা করা হয় ঢাকার প্রবেশমুখে পাঁচ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি।

দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি মামলা-হামলা আর নির্যাতনের পরও প্রতিটি কর্মসূচিতে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে ‘ডু অর ডাই’ অবস্থানে নেতাকর্মীরা। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে সরকার পতনের ‘এক দফা’ আন্দোলনে অনমনীয় ভূমিকা পালন করছেন তারা। তবে সর্বশেষ ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীর উপস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে দলটিতে। এ কারণে হঠাৎ করে অনুপস্থিতির কারণ খুঁজতে শুরু করেছেন দলের হাইকমান্ড।

দলটির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, এক দফা আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি ‘ঢাকাসহ সারাদেশে পদযাত্রা’ অনেকটা নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হলেও বিপত্তি ঘটে মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে। সারাদেশ থেকে আসা নেতাকর্মীকে পথে পথে বাধা, গ্রেপ্তার, তল্লাশির ভোগান্তির পর ভেন্যু নিয়েও সৃষ্টি হয় জটিলতা। তবে সবকিছু অতিক্রম করে একটি সফল মহাসমাবেশ করে দলটি। সমাবেশ থেকে ঘোষিত ঢাকার প্রবেশমুখে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ স্থানে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণার পর প্রশাসনের অনুমতি না দেওয়ায় শঙ্কা তৈরি হয় বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে। পাশাপাশি সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের পাল্টা প্রতিরোধের ঘোষণা তো রয়েছেই।

এ পরিস্থিতিতে যে কোনো মূল্যে এ কর্মসূচি অনুষ্ঠানের বিষয়ে অনড় থাকেন দলের সিনিয়র নেতারা। সে বিষয়ে সব প্রস্তুতিও গ্রহণ করে দলটি। কিন্তু প্রতিটি স্থানে যে পরিমাণ নেতাকর্মীর উপস্থিতি থাকার পরিকল্পনা ছিল, তা হয়নি। এমনকি অনেক স্থানে দায়িত্বশীল নেতারাও হাজির ছিলেন না। বিভিন্ন বিভাগ ও জেলার নেতাদের মধ্যেও দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে তারাও ঠিকমতো উপস্থিত থাকতে পারেননি। যেসব নেতাকর্মী উপস্থিত হতে পেরেছেন, তাদের মধ্যেও অনেকে এককভাবে অংশ নিয়েছেন। অনেকে দু-একজন অনুসারী নিয়ে অংশগ্রহণ করে নিজের দায়িত্ব দায়সারা পালন করেছেন।

জানা গেছে, বিএনপির মূল্যায়ন তালিকায় অবস্থান কর্মসূচিকে ঘিরে প্রত্যেক নেতাকর্মীর আমলনামা তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটি স্থানে উপস্থিত নেতাদের তালিকার পাশে তাদের ভূমিকা, তাদের অনুসারীদের অবস্থান তুলে ধরা হচ্ছে। যারা অনুপস্থিত ছিলেন, সময়মতো হাজির হননি, গাফিলতি করেছেন, দলের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে সামনে রেখে একজন আরেকজনকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন, তাদের তালিকাও তৈরি করছে দলটি। এতে গাফিলতির কারণ, উদ্দেশ্য সবকিছু উল্লেখ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সাহসী আর ত্যাগীদের সামনে আনার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।

দলীয় সূত্র জানায়, আগামীতে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরুর আগে দলের অভ্যন্তরীণ এ বিষয়গুলোকে আগে সমাধান করতে চায় দলের হাইকমান্ড। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এ তালিকা ধরে কৈফিয়ত তলবের পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। প্রত্যাশিত জবাব না পেলে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত রয়েছে।

তালিকা প্রস্তুত করার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন নেতা সমকালকে জানান, ঘোষিত পাঁচটি স্থানে অবস্থান কর্মসূচিতে যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুটিকয়েক নেতার কঠোর অবস্থানের কারণে নেতাকর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। কিন্তু ওই এলাকার মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক নেতাই ছিলেন নির্লিপ্ত। গরহাজির থেকে নিজের উপস্থিতিকে জানান দেওয়া ছাড়া তাদের কারও কোনো ভূমিকা ছিল না। ছাত্রদল ও যুবদলের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। উত্তরার স্থানে ছাত্রদল ও যুবদলের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। এখানে মহানগর বিএনপি আর শ্রমিক দলের নেতাকর্মীর ওপর ভর করেই মূলত কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন নেতারা। গাবতলীতে আমান উল্লাহ আমান যখন মাঠে নামেন, তখন গুটিকয়েক নেতাকর্মী ছাড়া দায়িত্বশীল নেতাদের দেখা যায়নি। উপস্থিত নেতাকর্মীর মধ্যেও বেশির ভাগের গরহাজির মনোভাব ছিল। নয়াবাজারের দলীয় কার্যালয়ের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান নেওয়ায় তাৎক্ষণিক স্থান পরিবর্তন করে ধোলাইখাল এলাকায় নেওয়া হয়।

সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের আগে সর্বসাকল্যে হাজারের মতো নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা তাদের অনুসারী, কর্মীবাহিনী ছাড়াই দায়সারা হাজির হন এসব কর্মসূচিতে। দলের করা প্রতিবেদনে এসব কিছু উঠে এসেছে বলে ওই নেতা জানান।

অবশ্য অনেক নেতা অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীর অবহেলার বিষয় মানতে নারাজ। তাদের মতে, বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর সরকারি দল যেন যুদ্ধ ঘোষণা করে। সকাল থেকেই প্রত্যেক স্থানে হাজার হাজার পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মহড়া ছিল। এসব প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা সাহস করে, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মসূচি সফল করেছেন। এ কর্মসূচি পালনকালে পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী বুলেটের আঘাতে আহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১২৪ জন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালনকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সরকারদলীয় সশস্ত্র ক্যাডাররা। ব্যাপক গুলিবর্ষণ, অজস্র কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও বেপরোয়া লাঠিচার্জে অগণিত নেতাকর্মীকে গুরুতর আহত করা হয়। এর পরও নেতাকর্মীরা অসীম সাহসের সঙ্গে কর্মসূচি সফল করেছেন।

দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, অভ্যন্তরীণ আত্মসমালোচনার পাশাপাশি বাধা-বিঘ্ন, হামলা-মামলার মধ্য দিয়েও তাদের কর্মসূচি সফল হয়েছে। দেশে-বিদেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেখানে বিরোধী দলের একজন সিনিয়র নেতাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার দৃশ্য যেমন রয়েছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতি বাড়াবাড়ির ঘটনাও রয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ রকম একটি ভয়াবহ দৃশ্য পুরো বিশ্ব দেখেছে। যেসব ঘটনা সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে আরও জোরালো হবে।

তিনি জানান, রাজপথের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে কাজ করছে দলটি। এবার কোনোভাবেই ক্ষমতাসীন সরকারকে আর ছাড় দিতে রাাজ নন তারা। ধারাবাহিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করতে নতুন কর্মসূচির বিষয়ে দল ও সমমনা দল এবং জোটের মধ্যে আলোচনা চলছে।