প্রকাশিত : সোমবার, ৮ জানুয়ারি ২০২৪

Share This News

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ২১৬৫৮ কোটি টাকা

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ২১৬৫৮ কোটি টাকা

 ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) রেকর্ড খেলাপি ঋণে জর্জরিত। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ছাড়াল সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে এত পরিমাণ খেলাপি ঋণের সম্মুখীন হতে হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এছাড়া নানা অনিয়মের কারণে ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় আমানত পেতে সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ থাকার কারণে অনেকে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ক্রমেই বেড়ে চলছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ৮০৬ কোটি টাকায়। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ হয়েছে ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর তিন মাস আগে গত জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ স্থিতি ছিল ৭২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা, এপ্রিল-জুন সময়ে ২ হাজার ৯৬ কোটি এবং জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এখন একাধিক চ্যালেঞ্জে পড়েছে। এর মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ডলার সংকট। দুই সংকট দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে। এছাড়া নির্বাচনের কারণেও একটা প্রভাব পড়েছে। তাই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কমে যাবে আশা করা যায়। সবাই চেষ্টা করছে খেলাপি ঋণ কমাতে।

তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধে কভিডকালে দেয়া সুবিধা প্রত্যাহার করার পর থেকে মন্দ ঋণ বেড়ে চলছে।

তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার ৯০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পিপলস লিজিংয়ে, যার হার ৯৯ দশমিক ০২ শতাংশ। এরপর বিআইএফসির ৯৬ দশমিক ৮৫, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৯৪ দশমিক ৪১, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৯৪ দশমিক ৭৬ এবং জিএসপি ফাইন্যান্সের ৯২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এছাড়া খেলাপি ঋণের হারে রয়েছে এফএএস ফাইন্যান্স ৮৯ দশমিক ৫৬, ফাস্ট ফাইন্যান্স ৮৯ দশমিক ৪১, প্রিমিয়ার লিজিং ৬৬ দশমিক ৭৪, সিভিসি ফাইন্যান্স ৫৯ দশমিক ৩৯, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স ৫৯ দশমিক ১৭, আইআইডিএফসি ৫৮ দশমিক ৬৪, ফিনিক্স ফাইন্যান্স ৫৭ দশমিক ৭৭, হজ্জ ফাইন্যান্স ৫৭ দশমিক ৭৯, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স ৫৬ দশমিক ৮৬, বে লিজিং ৫২ দশমিক ৮২, উত্তরা ফাইন্যান্স ৫০ দশমিক ৮২ এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ৪৩ দশমিক ১২ শতাংশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে খেলাপি ঋণের যে তথ্য পাঠানো হয়, তা প্রকৃত চিত্র নয়। এ খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার চেয়ে অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শনে গেলে তখন কিছু এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়।

তিনি জানান, এ খাতে বিপুল পরিমাণ ঋণ অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির কারণে দুর্বল এনবিএফআইয়ের সংখ্যা  বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশের ৩৫টি এনবিএফআইয়ের মধ্যে ১৪টি রেড জোনে ছিল, যা ২০২১ সালের ১২টির চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এ পরিস্থিতির জন্য মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায়ী। তিনি বলেন, এনবিএফআইয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ব্যাংকগুলোর মতো মানসম্মত নয়, যা গত কয়েক বছরে এ খাতের কেলেঙ্কারি ও ঋণ অনিয়মের প্রতিবেদনে ঘনঘন ফুটে উঠেছে।

দুর্বল এনবিএফআইগুলোর পাঁচ থেকে ছয়টি বন্ধ এবং আরও অর্ধডজন এনবিএফআইকে একীভূত করার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সাবেক গভর্নর।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে এত বেশি ব্যাংক ও এনবিএফআই রয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে সবগুলো তদারকি করা বেশ কঠিন।’

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তিশালী ভূমিকা থাকা দরকার। যাদের কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের এই হাল হলো, তাদের তো কোনো শাস্তি হলো না। পি কে হালদার কার লোক, এটা সবাই জানে। এজন্য আমানতকারীদের ভালো প্রতিষ্ঠান দেখে টাকা জমা রাখতে হবে।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি পরিদর্শন দল এক ডজন এনবিএফআইয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির সন্ধান পান। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑপিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), প্রিমিয়ার লিজিং, উত্তরা ফাইন্যান্স ও ফার্স্ট ফাইন্যান্স।

পিকে হালদার আইএলএফএসএলের এমডি ছিলেন। অভিযোগ আছে, তিনি পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, রিলায়লেন্স ফাইন্যান্স ও এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন।

পিপলস লিজিং ২০১৯ সালের জুনে লিকুইডেশনের মুখোমুখি হয়েছিল, কারণ তহবিলের মেয়াদ পূর্তি সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু একে বিলুপ্ত করার পরিবর্তে পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার, যা এ খাতের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।